ডেঙ্গু রোগের নতুন যে উপসর্গগুলো দেখা যাচ্ছে
১০ জুলাই ২০২৩ ০৯:৩৭
ঢাকা: চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে— এমন আশঙ্কা ছিল বছরের শুরু থেকেই। সেই আশঙ্কাকে বাস্তব রূপ দিয়ে দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মাঝে দেখা দেওয়া নতুন কিছু উপসর্গ যা এর আগে তেমন ছিল না। ফলে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন অনেক রোগী।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে ডেঙ্গু জ্বর হলে তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে ধরণ। যে বিষয়ে নাগরিকদের মধ্যে অনেকেই এখনও সেভাবে সচেতন না। এ কারণেই অনেক রোগী দেরিতে নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন। কেউ কেউ শরীরে ব্যথা অনুভব করে ফার্মেসি থেকে ওষুধ খাচ্ছেন কিন্তু পরে জ্বর এলেও বুঝতে পারছেন না। এ জন্য হাসপাতালে ভর্তিতেও ডেঙ্গু আক্রান্তের মধ্যে কাজ করছেন উদাসীনতা। সময়ক্ষেপণ করে যখন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে পরিস্থিতি। আর তাই প্রয়োজন উপসর্গ দেখা দেওয়ার শুরুতেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়া।
কোন ধরণের উপসর্গ দেখলেই ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যাবেন?
সাধারণত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে জ্বর, প্রচুর মাত্রায় মাথাব্যথা, শরীর ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। তবে এবার এগুলোর সঙ্গে আরও কিছু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা নিয়েছেন মুগদার এই হাসপাতালটিতে। এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ২০ রোগী, যাদের অধিকাংশই ভর্তি হয়েছিলেন একদম শেষ মুহূর্তে।
ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘ডেঙ্গুর যে প্রচলিত উপসর্গগুলো আছে সেগুলোর সঙ্গে মানুষ পরিচিত। তবে নতুনভাবে কিছু বিষয় আমরা এবার লক্ষ্য করছি যার সঙ্গে অনেকেই আসলে অবগত না। আর তাই দেরিতে হাসপাতালে আসা রোগীর সংখ্যা এবার বেশি।’
আর তাই জ্বর, প্রচুর মাত্রায় মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথার মতো উপসর্গের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু বিষয়ে সবাইকে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ ডা. নিয়াতুজ্জামানের। হাসপাতালে আসা রোগীদের মাঝে নতুন যেসব উপসর্গ বেশি দেখা যাচ্ছে-
১. ডায়রিয়া
বর্তমানে ডেঙ্গুর নতুন যেসব উপসর্গ দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে ডায়রিয়ার বিষয়ে উল্লেখ করতেই হয়। অনেকেই দেখা যাচ্ছে তিন থেকে চার দিন ধরে ডায়রিয়ায় ভুগছেন কিন্তু সেটি ভাল হচ্ছে না। এমন উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর যে ডায়ারিয়া হয় তার সঙ্গে সাধারণ ডায়রিয়ার কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। যে কারণে ডায়রিয়ার সময়কাল যদি বেশি হয় তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
২. জ্বর এলেও টের না পাওয়া বা গুরুত্ব না দেওয়া
এবার হাসপাতালে এমন অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন যারা এ মৌসুমে জ্বরে আক্রান্তই হননি। অর্থাৎ জ্বর না হলেও পরীক্ষার পর তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত বলে জানা গেছে। মৌসুমের শুরুর দিকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া একাধিক গুরুতর রোগীর মধ্যে দেখা যায়, তাদের কোনো জ্বর নেই। মূলত তারা ডায়রিয়াজনিত রোগে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে পরীক্ষা করে দেখা যায় তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত।
আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তীব্র গরমের মাঝে অনেকে হালকা জ্বরের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এরপরেই দেখা যায় তাদের শরীরে ডেঙ্গুর তীব্রতা বাড়তে থাকে ও পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হয়।
৩. প্রচুর মাত্রায় মাথা ব্যথা, খিঁচুনি, ঘাড় ও হাত-পা শক্ত হয়ে যাওয়া
যদি অল্প মাত্রায় জ্বর আসার পরে কারো প্রচুর পরিমাণে মাথা ব্যথা থাকে তবে সেটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, হাত-পা শক্ত হয়ে যায় ও এর পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে খিঁচুনিও দেখা যায়। এমন কোনো উপসর্গ যদি দেখা যায় তাহলে দেরি না করে অবশ্যই ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো উচিত।
এছাড়া যে কোনো ধরণের মাথা ব্যথা, শরীরে ব্যথার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ছাড়া ফার্মেসি থেকে পরিচিত কারো মাধ্যমে নিজেরাই ব্যথানাশক ওষুধ নিচ্ছেন। এটা আরও বিপদ বয়ে আনছে অনেক ক্ষেত্রে।
৪. জ্বরের পরে স্থায়ীভাবে বমি হওয়া
কিছু রোগীর ক্ষেত্রে জ্বর আসার পরে বমি শুরু হয়। এরপরে সেটা আর সেভাবে কমে না। এমন কোনো উপসর্গ দেখা গেলে অবশ্যই গুরত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একইসঙ্গে ডেঙ্গুর নমুনা পরীক্ষাটাও করে ফেলা প্রয়োজন।
এ ছাড়া অনেক রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হাত-পা খুব দ্রুত ফুলে যাচ্ছে। কিছু রোগী অসহ্য পেট ব্যথার জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে আসছেন কিন্তু তাদের ডেঙ্গু পরীক্ষার ফলাফলে পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে।
আরেকটি উপসর্গ এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মাঝে বেশি দেখা যাচ্ছে আর তা হলো শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে যাওয়ার মতো লক্ষণ। বিশেষ করে বুকে এবং পেটে যদি পানি জমে যায় সেক্ষেত্রে আর কোনোভাবেই দেরি করা যাবে না। এমন উপসর্গ দেখা মাত্র কাছে থাকা হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে।
ডেঙ্গুর যেসব উপসর্গ এবার দেখা যাচ্ছে তার সবগুলোই একজন রোগীর মাঝে থাকবে বিষয়টা এমন না জানিয়ে ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘কিছু কিছু রোগীর শুধু একটা উপসর্গ থাকে, আবার কারো মাঝে থাকতে পারে একাধিক উপসর্গ। এটা আসলে নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর বা ডেঙ্গু কোন পর্যায়ে রয়েছে সেটির ওপর।
যারা এবার হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের মাঝে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা বেশি। ফলে দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে তাদের পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হচ্ছে।
আর তাই উপরে উল্লেখিত উপসর্গগুলোর একটি দেখা গেলে দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষা করানোর পরামর্শ ডা. নিয়াতুজ্জামানের।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দেখছি যে অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু তারা সময় মতো পরীক্ষা করছেন না। এতে তারা নিজেদেরই ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। আর যে অবস্থায় হাসপাতালে আসছেন, সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ জন্য বলব, যারই ডেঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তারই দ্রুততার সঙ্গে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘ছোট বাচ্চা, বয়স্ক এবং যাদের অন্যান্য রোগ আছে, ডেঙ্গুতে তাদের ঝুঁকিটা একটু বেশি। বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস, হাইপ্রেসার, কিডনি, লিভার, স্ট্রোক ও ক্যান্সারের রোগী, তাদের একটু বেশি সচেতন থাকতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে কালক্ষেপণ না করে দ্রুততার সঙ্গে হাসপাতালে এসে পরীক্ষা করতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ‘ডেঙ্গু পরীক্ষাসহ ডেঙ্গু চিকিৎসায় আমরা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন করে দিয়েছি। গাইডলাইন অনুযায়ীই সবাইকে চিকিৎসা দিতে হবে। প্লেটলেট ব্যবহার নিয়েও গাইডলাইনে নির্দেশনা রয়েছে। একইভাবে কোনো পরীক্ষার ফি কত হবে সেটিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।’
সারাবাংলা/এসবি/ইআ