Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৬২ জেলায় ডেঙ্গু, জটিলতা বাড়াচ্ছে একাধিক ধরন

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৩ জুলাই ২০২৩ ২১:৫৪

ঢাকা: চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে— এমন আশঙ্কা ছিল বছরের শুরু থেকেই। সেই আশঙ্কাকে বাস্তবতায় রূপ দিয়ে দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। ১২ জুলাই পর্যন্ত দেশের ৬২টি জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এবার নানা কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অপরিকল্পিত মশানিধন কর্মসূচির পাশাপাশি সমন্বয়হীনতার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একাধিক ধরন শনাক্ত হওয়া।

বিজ্ঞাপন

মৌসুমের শুরু থেকেই গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদদের।

ডেঙ্গু ছড়িয়েছে ৬২ জেলায়

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৬২টি জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুমুক্ত আছে সুনামগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা।

সক্রিয় ডেঙ্গুর একাধিক ধরণ

দেশে চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের নমুনা বিশ্লেষণ করে একাধিক ধরনের উপস্থিতি মিলেছে। এর মাঝে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষণা বলছে, এবারই প্রথম ডেন-টু ধরনের ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি দেখা যাচ্ছে। এ বছরের ডেঙ্গু রোগীদের ৫১ ভাগই ডেন-টুতে আক্রান্ত।

আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন জানান, ডেঙ্গুর সেরোটাইপ বা ধরন চারটি। এবার ডেঙ্গু আক্রান্তদের ধরন জানতে রাজধানীর ৩০০ রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর। নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৫১ দশমিক ৫ শতাংশের সংক্রমণ ডেন-২–এ এবং ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশের সংক্রমণ ডেন-৩–এ। বাকি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ রোগী একই সঙ্গে ডেন-২ ও ডেন-৩–এ আক্রান্ত। ডেন ওয়ান ও ফোরে আক্রান্ত কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি।

বিজ্ঞাপন

একাধিক ধরন থাকা বিপজ্জনক

ডেঙ্গুর একাধিক ধরন থাকায় চলতি মৌসুমে রোগীর জটিলতা ও মৃত্যু বাড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মৃত্যুহার বেশি। ডেন টু-তে আক্রান্তদের জটিলতা বেশি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম ও দীর্ঘ মেয়াদী রোগে যারা আক্রান্ত তাদের ঝুঁকি আরও বেশি।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি এক নজরে

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, ১২ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৬ হাজার ১৪৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মাঝে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১১ হাজার একজন। ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন পাঁচ হাজার ১৪২ জন।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১২ জুলাই পর্যন্ত মারা গেছেন ৮৮ জন। এর মাঝে শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে মারা গেছেন ৬৯ জন। বাকি ১৯ জনের মাঝে সর্বোচ্চ ১২ জন মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে তিন জন, রাজশাহী বিভাগে দুই জন এবং রংপুর ও বরিশাল বিভাগে একজন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন। খুলনা ও সিলেট বিভাগে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে

চলতি মৌসুমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার একাধিক জরিপে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ঢাকা শহরের ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা বেশি।

তবে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরে সীমাবদ্ধ নেই। বলা যায় প্রায় সারাদেশেই এডিস মশা এখন বংশ বিস্তার করছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় সারাদেশেই আমরা এডিস মশার অস্তিত্ব পেয়েছি জরিপ চালিয়ে। এক্ষেত্রে বলা যায় ডেঙ্গু এখন আর কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকা, থানা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, জেলা বা বিভাগে সীমাবদ্ধ নেই। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বেশি। একইভাবে মৃত্যুর সংখ্যাও এবার বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে বছরের শুরু থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তবে রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে সংক্রমণের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

সমাধান কী?

কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘হটস্পট ব্যবস্থায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগী যেসব এলাকা থেকে বেশি আসে, সেখানে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। দরকার হলে সেখানে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। তাহলে এক রোগী থেকে অন্য রোগী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। যদি এমনটা না হয় তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। বাসা বাড়ি বা আশপাশে যেন পানি জমা না থাকে, পানি জমার মতো কোনো পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, কোথাও যেন পরিত্যক্ত টায়ার বা কোনো ধরনের পাত্র পড়ে না থাকে। এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’

জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. বেনজীর আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু যে দেশে ঢোকে, সেখান থেকে বের হয় না। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের দেশে দুই যুগের বেশি সময় ধরে এর নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করা হয়নি। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলেও এটি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট কার্যকর ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি একটি সঠিক কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘দেশে ডেঙ্গুর একাধিক ধরন ছড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মুহূর্তে মশক নিধন করা।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মশক নিধন কর্মসূচির পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারিভাবে প্রচার-প্রচারণা জোরদার করা দরকার, যাতে মানুষ সচেতন হয়।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, ডেঙ্গু যখন কোনো কমিউনিটিতে প্রবেশ করে, তখন তাকে একেবারে নির্মূল করা যায় না। যেহেতু সামনে আরও নগরায়ণ হবে, আরও উন্নয়ন হবে, আমাদের আগে-ভাগে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।’

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রভাব বাড়ছে। এই সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে হলে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘সবাইকে নজর রাখতে হবে যে, বাসাবাড়ির ছাদ ও আঙিনায় যেন পানি জমে না থাকে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার কামড় থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।’

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

৬২ জেলা একাধিক ধরন ডেঙ্গু

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ভারত থেকে ফিরলেন ৯ বাংলাদেশি তরুণী
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:২৩

আজ জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেবেন ড. ইউনূস
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:০৪

সবজি-মুরগির বাজার চড়া, অধরা ইলিশ
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:১০

সম্পর্কিত খবর