Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এডিস মশা শুক্রবার কামড়ায় না?

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২১ জুলাই ২০২৩ ২১:০৪

ঢাকা: বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আর এই রোগের ভাইরাস হয়ে উঠেছে আরও শক্তিশালী। আগে বর্ষাকালের রোগ বলা হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ১২ মাসই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছে হাসপাতালে, মারাও যাচ্ছেন অনেকে। প্রচলিত ধারণা ভেঙ্গে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা এখন শুধু দিনে না বরং রাতেও কামড়ায়। আগে স্বচ্ছ পানিতে জন্মালেও এখন এডিস মশা ঘোলা ও লবণাক্ত পানিতে জন্মাতে পারে- এমনটাই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

শুধু পালটায়নি ডেঙ্গু রোগ আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সরকারি তথ্য দেওয়ার প্রক্রিয়া। রাজধানীর মাত্র ৪৯টি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও ২০টি সরকারি হাসপাতালের পরিসংখ্যান নিয়ে ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের পাশাপাশি মৃত্যুর পরিসংখ্যান জানানো হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ঢাকা মহানগরীর বাইরে অন্যান্য জেলা পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তথ্য। তবে সপ্তাহের ছয় দিন এই সব প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেলেও শুক্রবার মেলে না তথ্য। ফলে শুক্রবার আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নেমে আসে প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি।

বিজ্ঞাপন

কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, শুক্রবার মূলত অনেক হাসপাতাল থেকেই রিপোর্ট পাঠানো হয় না।

রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম দেখে নাগরিকদের প্রশ্ন, এডিস মশা কী তবে শুক্রবার কামড়ায় না?

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এডিস মশা দিন দেখে বা সময় দেখে কামড়ায় না। সে সুযোগ পেলেই রক্ত চুষে নেবে। আর তাই ডেঙ্গু পরিস্থিতি যখন উদ্বেগজনক তখন ছুটির দিন বলে রিপোর্ট হবে না— এমনটি হওয়া উচিত না। ছুটি থাকলেও এই রিপোর্ট দৈনিক ভিত্তিতে আপডেট থাকা উচিত। তাছাড়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে রিপোর্টিংয়ের জন্য খুব একটা বেশি বেগ পাওয়ারও কথা না। এটি আসলে একধরনের অবহেলা। যার ফলে ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না সামনে।

শুক্রবার কমে যায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা

দেশে বুধবার (১৯ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা সময়ে এক হাজার ৭৫৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। এই ২৪ ঘণ্টায় ৯ জনের ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের তথ্য জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

তবে বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার (২১ জুলাই) সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নেমে আসে অর্ধেকে। এ সময় ৮৯৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। একইসঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক জন রোগী মারা গেছে বলেও জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

এদিনের রিপোর্টে জানানো হয়, রাজধানীর ছয়টি সরকারি হাসপাতাল ও ২৯টি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে রিপোর্ট না পাঠানোর কারণে তা সংযুক্ত করা হয়নি।

শুধু চলতি সপ্তাহেই নয়, আগের সপ্তাহেও দেখা গেছে প্রায় একই পরিস্থিতি।

বুধবার (১২ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) সকাল ৮টা পর্যন্ত এক হাজার ২৩৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। এ সময় মৃত্যুবরণ করেন পাঁচ জন। তবে বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) থেকে শুক্রবার (১৪ জুলাই) পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নেমে আসে অর্ধেকেরও কম সংখ্যায়। এই ২৪ ঘণ্টায় ৪৪৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।

মূলত দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে এমন চিত্রই দেখা যায় বছরের পর বছর।

সমস্যা কোথায়?

ডেঙ্গু পরিস্থিতি যখন উদ্বেগজনক, মশা যখন বংশবিস্তার সক্ষমতা বাড়িয়েছে তখন ডেঙ্গু শনাক্তে দেশের কত মানুষ নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন, কারা আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাতে এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সংস্থাটি রাজধানী ঢাকার ২০টি সরকারি ও প্রায় অর্ধশতাধিক বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য প্রতিদিন তুলে ধরছে। এর সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে জেলা হাসপাতালের তথ্য। তবে এর বাইরে অসংখ্য রোগী সারাদেশের বিভিন্ন ক্লিনিক, ছোট-বড় হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসা নিলেও সে তথ্য নেই স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে।

একইসঙ্গে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দৈনিক ভিত্তিতে জানানো হলেও নমুনা পরীক্ষার সংখ্যাও জানা নেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের।

প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টার (এমআইএস) শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. অধ্যাপক শাহাদাৎ হোসেন জানান, এখন পর্যন্ত সারা দেশে কতজন ডেঙ্গু নমুনা পরীক্ষা করিয়েছেন তার কোনো পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে নেই।

জুন মাসে ডেঙ্গু চিকিৎসার তথ্য প্রদানসহ সাতটি নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে অভিযোগ রয়েছে, সমণ্বয়হীনতা ও তদারকির অভাবে হাসপাতালগুলোতে এর একটি নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

জনস্বাস্থ্যবিদ ও সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ডেঙ্গুর বর্তমান উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সঠিক আক্রান্তের সংখ্যা সংখ্যা জানা খুবই জরুরি। কারণ তথ্যের ঘাটতিতে সংক্রমণের সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে নীতিনির্ধারকদের কাছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিষয়ে হয়তবা ভুল বার্তা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে সারাদেশের গ্রাম পর্যায়েও ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। ঢাকার বাইরে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক রিপোর্টিং হচ্ছে না। বাস্তবে ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা তাই আরও অনেক বেশি। এক্ষেত্রে হাসপাতাল বিভাগ কিন্তু চাইলে সহজেই রিপোর্টগুলো সংগ্রহ করতে পারে। তার লাইসেন্স প্রক্রিয়াতে নিবন্ধনের সময়েই কড়াকড়ি আরোপ করে তথ্য দেওয়ার নিয়ম করতে পারে। এর ফলে হাসপাতালগুলো তথ্য দিবে অনেকটা বাধ্য হয়েই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এডিস মশা সুযোগ পেলেই কামড়াবে। এটিই তার বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে সে দিন বা ক্ষণ দেখবে না। উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরাও রোগীদের সেবা দিবে সবসময়। এমন অবস্থায় রিপোর্টিংয়ে কেনো গাফিলতি থাকবে? প্রতিষ্ঠান শুক্রবার হওয়ার কারণে তথ্য দেয় নাই আর তাই আপডেট হয়নি— এমনটি তো আসলে দায় এড়ানোর কথামাত্র।’

জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এডিস মশা সুযোগ পেলেই কামড়াবে। সে মানুষকে খুঁজে বেড়ায় রক্ত শোষণের জন্য। আর তাই তার জন্য আলাদা কোনো দিনক্ষণ নেই। কিন্তু দেশে ডেঙ্গুর উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে তথ্য না পাওয়ার কারণে কম রিপোর্টিং হবে এমনটা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে পুরোই বেমানান। এটি হওয়া উচিত যে সব ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল অর্থাৎ যে সব জায়গায় নমুনা পরীক্ষা হয় সেখান থেকে একটি সফটওয়্যার বা অ্যাপসের মাধ্যমে তথ্য পাঠিয়ে দেওয়া হবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। সেক্ষেত্রে ছুটির দিনে রিপোর্টিং না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক।’

তিনি বলেন, ‘এখানে আসলে নজরদারির অভাব রয়েছে। কর্তৃপক্ষের মনোযোগের অভাবেই এমনটি হচ্ছে। এর কারণে সংক্রমণ পরিস্থিতি বোঝা অস্বচ্ছ হয়ে যায়। যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়ে কর্তৃপক্ষের জন্য।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংক্রমণ পরিস্থিতি বুঝতে হলে সঠিক তথ্য প্রয়োজন। এলাকাভিত্তিক তথ্যের পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষার সংখ্যাও জানা প্রয়োজন। অথচ দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে আমাদের এতো এত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরেও তথ্য ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুর সঠিক সংক্রমণ চিত্র আমরা কোনোভাবেই পাচ্ছি না। সেটি পেলে তো আর শুক্রবার রোগীর সংখ্যা প্রতি সপ্তাহে কমত না, আর এর আগে পরে বাড়ত না। মূলত এটি আসলে যারা রিপোর্ট করে ও যারা রিপোর্ট দেয় তাদের অবহেলা। আর আন্ডার রিপোর্টিং অর্থাৎ যে পরিমাণ আক্রান্ত হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান না পাওয়ার কারণে সংক্রমণ পরিস্থিতিও বুঝছি না। ঢাকার বাইরের বেসরকারি হাসপাতালে রোগীরা চিকিৎসা নিলেও তার কোনো তথ্য নেই খোদ ঢাকাতেই সব প্রতিষ্ঠানের তথ্য নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে ডেঙ্গুর যে অবস্থা তা অবশ্যই উদ্বেগজনক। এমন অবস্থায় পরিস্থিতি বুঝতে হলে সঠিক রিপোর্টিং প্রয়োজন। কোন ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে কত জন রোগী আক্রান্ত তার সঠিক চিত্রটা জানা জরুরি।’

এডিস মশা সবসময়েই কামড় দেবে। সে মানুষকে কামড় দেবে কোনো দিন, ক্ষণ দেখা ছাড়াই। সে তো আর শুক্রবার বা শনিবার বোঝে না। তবে আমরা বুঝি শুক্রবার আসলে সরকারি ছুটি যেদিন কোনো কাজ করতে হবে না- আর এই কারণেই শুক্রবার কোনো রিপোর্টিং হয় না। কর্তৃপক্ষও হয়ত বা ছুটি কাটাতে পছন্দ করে আর তাই দেশের এমন উদ্বেগজনক অবস্থায় রিপোর্টিং না হওয়ার বিষয়টি খুবই হালকাভাবে নিয়ে ফেলে বড় বড় কর্মকর্তারা- যোগ করেন অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

কর্তৃপক্ষ কী বলছে?

শুক্রবার কেনো কম রিপোর্টিং হয় এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশেদা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট যুক্ত করা হয়। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে রিপোর্ট আসে না।

তবে শুক্রবার রাজধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ একাধিক সরকারি হাসপাতালের রিপোর্ট সংযুক্ত করা হয় নি।

এমন তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, ‘এমন হওয়ার কথা না। একটু আপডেট তথ্য নিয়ে জানাতে হবে।’

সারাবাংলা/এসবি/একে

এডিস মশা ডেঙ্গু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর