Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাই ছিল ভয়ঙ্কর, আগস্টে ডেঙ্গু হতে পারে আরও ভয়াবহ

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১ আগস্ট ২০২৩ ০৯:৪০

ঢাকা: চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে— এমন আশঙ্কা ছিল বছরের শুরু থেকেই। সেই আশঙ্কাকে বাস্তবতায় রূপ দিয়ে দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। এ বছর জুলাই মাসেই অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী আরও ২৩ বছরে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী জুলাই মাস পর্যন্ত এতো বেশি সংখ্যক রোগীর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তথ্যও এর আগে পাওয়া যায়নি কোনো বছর। ২০২২ সালে দেশে সর্বোচ্চ ২৮১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার তথ্য জানানো হলেও চলতি বছরের শুধুমাত্র জুলাই মাসেই মারা গেছেন ২০৪ জন।

বিজ্ঞাপন

দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের যে পরিসংখ্যান তাতে দেখা যায়, আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসেই এর মাত্রা বাড়তে থাকে। তবে ২০২২ সালে অক্টোবর মাস পর্যন্ত আতঙ্ক ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। চলতি মৌসুমে জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে জুনে। পরবর্তীতে জুলাই মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানকে ভয়ঙ্কর বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ জুনের তুলনায় সাত গুণের বেশি মানুষ জুলাইয়ে আক্রান্ত হয়।

বিজ্ঞাপন

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই মাস ছিল ভয়ঙ্কর। তবে এটা আরও ভয়াবহ রূপ নিবে আগস্ট মাসে। এরপরে এখনও বাকি সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস। এমন অবস্থায় মশানিধন কর্মসূচি সফলভাবে পরিচালনা করা না গেলে পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে মশা নিধনের কোনো বিকল্প নেই। দ্রুত মশা নিধনের জন্য ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে হবে। উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে অন্তত পরিস্থিতি কিছুটা ভালো করা যেতে পারে। এমন কিছু করা না গেলে পরিস্থিতি হতে পারে ভয়াবহ।’

জুলাই মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাই মাসের ৩১ দিনে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২০৪ জনের। এই মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ৪৩ হাজার ৮৫৪ জনে।

প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫১ জনে। এর মধ্যে নারী ১৪০ জন এবং পুরুষ ১১১ জন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ৫৫ জন এবং রাজধানীতে ১৯৬ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৫১ হাজার ৮৩২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২৯ হাজার ২০০ জন।

ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ২২ হাজার ৬৩২ জন।

একই সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৪২ হাজার ১৯৫ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২৩ হাজার ৯৯৩ জন এবং ঢাকার বাইরের ১৮ হাজার ২০২ জন।

পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘অন্যবারের তুলনায় এবার জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত রোগীর যে সংখ্যা দেখা গেছে তা উদ্বেগজনক। তাই সামনের দিনগুলোতে সবাই সতর্ক না হলে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘হটস্পট ব্যবস্থায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগী যেসব এলাকা থেকে বেশি আসে, সেখানে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। দরকার হলে সেখানে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। তা হলে এক রোগী থেকে অন্য রোগী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। যদি এমনটা না হয় তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার সব জায়গায় ডেঙ্গু রোগীর হার সমান নয়। যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি, সেখানে মশক নিধনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। মাইকিং, জনসচেতনতা, ওষুধ ছিটানো— সবকিছু একসঙ্গে করতে হবে। এমনটা না করতে পারায় এখন পর্যন্ত জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু।’

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা একটা জরিপ করে দেখেছি যে, এদেশের মানুষ এডিস মশা কীভাবে হয়, প্রজননস্থল, বদ্ধ, স্বচ্ছ পানি- এই সবকিছুই জানে। তারপরও তারা সচেতন হন না। এটি একটা মানসিকতা। এর পরিবর্তন দরকার। আর সিটি করপোরেশন যতই বলুক তারা মশার উৎস ধ্বংস করছে। কিন্তু উড়ন্ত এডিস মশা থেকে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন কিন্তু ডেঙ্গু শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়েছে। আর তাই সারা দেশেই স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য। নতুবা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। এখন থেকেই আমাদের মশার প্রজনন ঠেকাতে হবে। মশার প্রজনন যদি আমার মৌসুমের শুরুতেই ঠেকাতে পারি, তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। বাসা বাড়ি বা আশপাশে যেন পানি জমা না থাকে, পানি জমার মতো কোনো পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, কোথাও যেন পরিত্যক্ত টায়ার বা কোনো ধরনের পাত্র পড়ে না থাকে, এই বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’

ধ্বংস করতে হবে মশার প্রজননক্ষেত্র
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, ডেঙ্গু যখন কোনো কমিউনিটিতে প্রবেশ করে, তখন তাকে একেবারে নির্মূল করা যায় না। যেহেতু সামনে আরও নগরায়ণ হবে, আরো উন্নয়ন হবে, আমাদের আগেভাগে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।’

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বেনজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু যে দেশে ঢোকে, সেখান থেকে বের হয় না। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের দেশে দুই যুগের বেশি সময় ধরে এর নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করা হয়নি। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলেও এর নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। আর তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি একটি সঠিক কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।’

এমন পরিস্থিতি কেনো
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গুর বাহক যে এডিস মশা, তাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে তো ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটতেই থাকবে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের জন্য সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে যে একটি সুসমন্বিত অভিযানের দরকার, সেটা আসলে পরিকল্পনাও করা হয়নি, শুরুও করা হয়নি। যে ওষুধ, মাঠপর্যায়ে সেটা কতটা কার্যকর, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সব মিলিয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার, ডেঙ্গুর বাহক যে এডিস মশা, সেটা দমন বা নির্মূল করার ব্যর্থতার জন্যই মূলত ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’

আগস্টে পরিস্থিতি হতে পারে আরও ভয়াবহ
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বেই হঠাৎ তাপদাহ বা অতিবৃষ্টি হচ্ছে। তাই সারা বছরই ডেঙ্গু থাকবে। তবে বর্ষার শুরু এবং শেষে এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি থাকবে। তাই জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতি হয়ে উঠে ভয়ংকর। আগস্ট মাসে আরও বাড়তে পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ।’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণ উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে থাকবে। এরপর ধীরে ধীরে কমবে। যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে, সংক্রমণ আগস্টে শীর্ষে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এবারের সংক্রমণকে ডেঙ্গুর দ্বিতীয় ঢেউ বলা যায়। কারণ গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নভেম্বর-ডিসেম্বরের পর একটু কম ছিল। চলতি বছর মার্চ থেকে বাড়তে শুরু করে।’

‘মশা মারতে না পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে’
সারাদেশে এডিস মশা মারতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘শুধু ঢাকা নয়, ডেঙ্গু যতটা মেডিকেল প্রবলেম, তার থেকে বেশি ইউনিভার্নমেন্টাল প্রবলেম। যে জায়গায় পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং বেশি জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘প্রাইমারি হেলথ এবং পাবলিক হেলথ এক নয়। পাবলিক হেলথ হচ্ছে জনগণকে সম্পৃক্ত করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা। এগুলো যদি আমরা বৃদ্ধি করতে না পারি, ডেঙ্গু রোগী যদি এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে, আমাদের জন্য ডিফিকালট হয়ে যাবে। জরুরি ভিত্তিতে মশা নিয়ন্ত্রণে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম, যারা এই সমস্ত কাজ (মশা নিয়ন্ত্রণ) করছেন, তারা যদি এই কাজগুলো আরও বেশি বৃদ্ধি করেন, যেভাবে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটা কমানো যাবে এবং ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাও যথাযথভাবে দেওয়া যাবে।’

অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর আরও বলেন, ‘সারাদেশেই বর্তমানে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এখন ঢাকা সিটির পাশাপাশি ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা বেশি। এডিস মশা যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন হবে।’

এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সরকারি হাসপাতালে আরও পাঁচ হাজার শয্যা প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। যেখানে শয্যা দেওয়া সম্ভব, সেখানেই প্রস্তুত করা হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কুয়েত-মৈত্রী, কুর্মিটোলা, বার্ন ইনস্টিটিউট, যেখানে জায়গা আছে শয্যা প্রস্তুতের জন্য বলে দিয়েছি। প্রায় ১ হাজার ৪০০ শয্যা নতুন করে বাড়াতে বলা হয়েছে। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালেও শয্যা রাখা হয়েছে।

সারাবাংলা/এসবি/এমও

আগস্ট ডেঙ্গু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর