Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘সরকারি হিসাবের চেয়ে ডেঙ্গু রোগী কয়েকগুণ বেশি’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১০ আগস্ট ২০২৩ ২৩:৫১

ঢাকা: দেশে প্রতিদিন বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর থেকে দেশের ইতিহাসে এরইমধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যানও ছাড়িয়ে গেছে। তবে সরকারিভাবে দেওয়া ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য প্রকৃত সংখ্যা নয় বলে ধারণা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। বরং যে পরিমাণ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে রোগীর সংখ্যা তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর তাই চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।

বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) রাজধানীর মহাখালীর নিপসম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এসব সুপারিশের বিষয়ে জানান বিশেষজ্ঞরা। ‘বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ: সামনে করণীয়’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা। তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখারও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

ডা. সানিয়া বলেন, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘুম হারাম হয়েছিল। ২০১৯ সালে সারা বছরে মারা গিয়েছিল ১৭৯ জন। এবার আগস্টের প্রথম সপ্তাহে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। সুতরাং বাকি দিনগুলোয় আমরা মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখতে পারব– এমন হবে না। মৃতের এই সংখ্যা দ্বিগুণও হয়ে যেতে পারে। আগস্টে ১ লাখের ওপরে কেস হয়ে যাবে। তাহলে আমরা কী মনে করবো এটা ডেঙ্গু মহামারী? এই কথা যদি এখন বলা হয় তবে কালকেই পত্রিকায় বিরাট বিরাট করে বের হবে আমরা এখন ডেঙ্গু মহামারিতে আছি। সেটার জন্য অনেক রকম সমস্যা হতে পারে। সে জন্য সরাসরি কোন উত্তর দিচ্ছি না। আমরা সারপ্লাস করে গেছি ২০২০ থেকে ২০২২ সালের সব রেকর্ড। ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার কেস হয়েছিল, চলতি বছর তা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অথচ আজকে আগস্টের ১০ তারিখ মাত্র এখনো।

তিনি বলেন, ‘আমরা জানি মুগদা হাসপাতাল রোগী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ তারা আর পারছে না। প্রাইভেট হাসপাতালে গুলোতেও সিট নেই। প্রাইভেট ক্লিনিকে যদি খুব খারাপ অবস্থায় রোগী যাচ্ছে তাদের ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। সে জন্য আমরা দেখছি ঢাকা মেডিক্যাল ও মুগদা হাসপাতালে বেশি মৃত্যু। দোষ গুণ না দিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের জঞ্জালের এই নগরীতে এখন এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে কন্টেইনার নেই। গণপরিবহন, হাসপাতাল, ফ্ল্যাট, পুলিশের থানায় ডাম্পিং স্টেশনে প্রচুর মশার লার্ভা পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলো পরিষ্কারে কারও উদ্যোগে নেওয়া হয় না। যে যার দায়িত্ব পালন করছে না। লার্ভিসাইড করতে হবে, সোর্স রিডাকশন করতে হবে। এখন যে এপিডেমিক সিচুয়েশনে বা ইমার্জেন্সি সিচুয়েশনে এই অবস্থায় আমাদের এডাল্টিসাইড করতে হবে।

ডা. সানিয়া বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ে জরিপ, তথ্য সংগ্রহ, নজরদারিতে ঘাটতি রয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে হাজার হাজার হাসপাতালের মধ্যে ৬৩টি হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুর তথ্য নেওয়া হয়। সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি, ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যু দুটোই অনেক অনেক (প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে) কম। এটা মিডল ইনকাম কান্ট্রির জন্য স্বাভাবিক, আমাদের পাশের দেশেও হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস সার্ভের বাইরে আমার তেমন কিছুই করতে পারি না। এর কারণ আমাদের দক্ষ জনবলের ঘাটতি। আমাদের কাজে ভুল রয়েছে। ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগে আমাদের লার্ভিসাইটিং করতে হবে। যেন এডিসের লার্ভা ধ্বংস করতে পারি। কিন্তু আমাদের করা হচ্ছে ফগিং। অথচ ফগিং এডাল্ট মশা নিধনের জন্য প্রয়োগ করা হয়। তাও বর্তমান সময়ে সেটা কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ডেঙ্গু নতুন কোনো রোগ নয়। এটি আমাদের দেশে ৬০ এর দশকে দেখা দেয়। এরপর ২০০০ সালে তা পুনরায় দেখা দেয়। যা এখন একটি বিরাট সমস্যা আকারে দেখা দিয়েছে। এটি প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ডেঙ্গু এককভাবে স্বাস্থ্য বিভাগের সমস্যা নয়, এটি এখন জনস্বাস্থ্য সমস্যা। চিকিৎসকরা বহু মানুষকে পরামর্শ দিচ্ছেন বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে। কিন্তু বহু মানুষ কখনো হাসপাতালেই যায় না।’

তিনি বলেন, ‘এ বছর আমরা ৭০ হাজার রোগীকে শনাক্ত করেছি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। এটা হচ্ছে কমিউনিটিতে ‘টিপ অব দি আইসবার্গ’। যারা আক্রান্ত হয়ে পরীক্ষা করান না, বা পরীক্ষা করালেও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না, তাদের সংখ্যা এই হিসাবে আসেনি। বাকি অন্তত পাঁচ গুণ বেশি রোগী কমিউনিটিতে আছে, যারা কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হয়েছেন বা সাসপেক্টেড। তারা কোনোভাবেই পরীক্ষা করছে না বা পরীক্ষা করার জন্য আসছে না। এই ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে যদি সম্পৃক্ত করা না যায়, এই রোগটা যে প্রাণঘাতী এই বিষয়ে যদি তাদের আমরা সম্যক ধারণা দিতে না পারি, তাহলে কিন্তু ফ্যাটালিটি কমার সম্ভাবনা নেই।’

ডেঙ্গু প্রতিরোধে কেমিক্যালের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে ৩০ শতাংশ এডাল্টিসাইট সফল হয়। যা আমরা ফগিংয়ের মাধ্যমে করে থাকি। মশা ইতোমধ্যে এটি প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। মশার আচরণগত পরিবর্তন হয়েছে। ফলে তার কার্যকর ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধের যে চিত্র দেখতে পারছি তা শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকার। সারা দেশের পরিস্থিতি কি তা আমরা জানি না। এটি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বড় অন্তরায়।’

সেমিনারে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘স্বাস্থ্যগত কারণে বাংলাদেশে কখনো ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হয়নি। রাজনৈতিক কারণে হয়েছে। এপিডেমিক হয়েছি কী হয়নি বিষয়টা স্পর্শকাতর। আগে কলেরা, প্লেগে শত শত মানুষ মারা যেত। গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে যেতো। হাজার হাজার মানুষ মারা গেলে এপিডেমিক কথাটা ব্যবহার হবে, বিষয়টি তা নয়।’

তিনি বলেন, ‘সোয়াইন ফ্লুতে সারা বিশ্বের লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। সেটি ছিল প্যান্ডামিক। কিন্তু এতে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। যখন টাইম, প্লেস, পার্সন পরিপ্রেক্ষিতে যে রোগ দ্বারা আন ইউজ্যাল মরবিডি, মর্টালিটি হয় সেটা যদি ওয়াইড এরিয়ায় হয়। একটা দুইটা যায়গায় হলে সেটা আউটব্রেক। ওয়াইড এরিয়ায় হলে এপিডেমিক অবশ্যই বলবো। এটা নিয়ে বাদানুবাদ করাটা বিব্রতকর।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকার কখনই গেজেটের মাধ্যমে স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেনি। বৈশ্বিক মহামারি করোনার সময়েও বাংলাদেশে সরকারিভাবে গেজেটের মাধ্যমে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও তা নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র ও গণপূর্তসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে টাস্ক ফোর্স গঠন করা যেতে পারে।’

ডা. মোশতাক বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে সময় লাগলেও সেটা অসম্ভব নয়। মশা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এখন আক্রান্ত রোগীকে যেন মশা না কামড়ায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এখন প্রতিটি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে মশারির ভেতর রাখা নিশ্চিত করা দরকার। যেমন কোভিডের সময় প্রতিটি আক্রান্ত মানুষকে মাস্ক পরতে বলা হয়েছিল। মশারির ভেতরে থাকলে এডিস মশা কামড়ানোর মত লোক পাবে না। রোগীকে কামড়াতে না পারলে সে ডেঙ্গুও ছড়াতে পারবে না।’

তিনি বলেন, প্রতিটি আক্রান্ত রোগীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আক্রান্তদের বেডরেস্ট এবং চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। ডেঙ্গু রোগীদের সম্ভব হলে আলাদাভাবে চিকিৎসা করতে হবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক শাহ মনির হোসেন।

তিনি বলেন, ‘সরকারের একার পক্ষে কখনোই ডেঙ্গু দূর করা সম্ভব না। এজন্য সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম এবং সর্ব সাধারণকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে দেশের সেবাদানকারী এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে সঠিক পরিকল্পনা করে, তা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে আমরা এই সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে পারি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করব, যেন এনজিও, প্রাইভেট সেক্টরকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কাজে যুক্ত করা হয়। হাসপাতালের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বল্প মেয়াদী জরুরি ব্যবস্থা এবং দীর্ঘ মেয়াদী ৫ বছর ১০ দশ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য আমরা সরকারকে অনুরোধ করব।’

সেমিনারে পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর মহাসচিব ডা. এস এম শহীদুল্লাহ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল, ডিএনসিসির সাবেক প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জোবায়দুর রহমানসহ চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া সেমিনারে সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ববিদ, টিকাবিশেষজ্ঞ, সাধারণ চিকিৎসক, গবেষক, সাংবাদিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

সারাবাংলা/এসবি/একে

এডিস মশা টপ নিউজ ডেঙ্গু


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর