Monday 02 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এখনও পলাতক ৫ খুনি, মাজেদের পর কে?

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৪ আগস্ট ২০২৩ ২১:১১

ঢাকা: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সেই কলঙ্কিত অধ্যায়ের হোতা হিসেবে ১১ খুনিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। তাদের ছয়জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সেই মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরও করা হয়েছে। সর্বশেষ ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মিশনে অংশ নেওয়া অন্যতম খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদুর রহমান মাজেদকে। এরপর গত প্রায় সাড়ে তিন বছরে আর কারও বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এই পাঁচজনই বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

পঁচাত্তরের সেই ভয়াল রাতের ঘটনার মামলায় আদালত চূড়ান্ত রায় দেন ২০০৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এরপর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর দীর্ঘ এক দশক পর ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয় ক্যাপ্টেন মাজেদের মৃত্যুদণ্ড।

বিজ্ঞাপন

এই ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর বঙ্গবন্ধুর বাকি পাঁচ খুনির খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয়নি, সম্ভব হয়নি তাদের বিরুদ্ধে দেয়া আদালতের রায় কার্যকর করা। বিভিন্ন দেশে পলাতক এই পাঁচজন হলেন খন্দকার আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, নুর চৌধুরী ও রাশেদ চৌধুরী।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিভিন্ন নথিপত্র থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্যাপ্টেন মাজেদ বঙ্গভবনে অবস্থান নেন। সেখান থেকে তিনি সহযোগী খুনিদের নিয়ে রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। একই বছরের ৩ নভেম্বর জেল হত্যার ঘটনাতেও অংশ নেন তিনি। জেল হত্যায় জড়িত থাকার দায়েও তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সাজা দিয়েছিলেন আদালত।

এদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের আওতায় না এনে উল্টো ‘পুরস্কৃত’ করেন। বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে তাদের নিয়োগ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ক্যাপ্টেন মাজেদকে পাঠানো হয় সেনেগালে। ১৯৮০ সালে তাকে সেখান থেকে দেশে ফিরিয়ে চাকরি দেয়া হয় নৌ পরিবহন অধিদফতরে।

এখানেই শেষ নয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েও নিয়োগ পেয়েছিলেন মাজেদুর। পরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পরিচালক হন তিনি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর প্রয়াত জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলেও তিনি সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেছেন।

পঁচাত্তরের পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যখন এভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছিল, তখন বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের বিচারের আশাই ছিল দুরাশা। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শেষ পর্যন্ত শুরু হয় সেই বিচারের প্রক্রিয়া। ওই বছর ধানমন্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় খুনিদের তিনজনকে।

১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে শুরু হয় বিচার। ২০২ কার্যদিবসে মোট ৬১ জনের সাক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৭১ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক ১৮ আসামির মধ্যে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও বাকি পাঁচজনকে খালাস দেন।

নিম্ন আদালতের সেই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেন। নিয়ম অনুযায়ী সেটি প্রধান বিচারপতি পাঠিয়ে দেন তৃতীয় বেঞ্চে। সেই তৃতীয় বেঞ্চের রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।

এদিকে ২০০১ সালে ফের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ আবার স্থবির হয়ে পড়ে। হাইকোর্টের রায়ের পর দীর্ঘ ছয় বছর আপিল বিভাগের সাতজন বিচারক মামলার শুনানিতে বিব্রতবোধ করেন। শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আসামিদের আপিল খারিজ করে দেন। হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পর শেষ হয় বিচার কার্যক্রম।

এরপর ছিল রায় কার্যকরের পালা। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচজন ও ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন মাজেদের ফাঁসি কার্যকরের পর সেই প্রক্রিয়াও থমকে আছে। বাকি খুনিদের আর সাজা কার্যকরের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা প্রতিবছর ১৫ আগস্ট এলেই বক্তব্যে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক খুনিদের ‘শিগগিরই’ দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে। কিন্তু সেসব খুনিদের কাউকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তাদের কবে নাগাদ দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে, সে বিষয়েও স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের কোনো পক্ষ থেকেই সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে জাতি কিছুটা কলঙ্কমুক্ত হয়েছিল। কিন্তু বাকি আসামিদের রায় কার্যকর না হওয়ায় কলঙ্ক থেকেই যাচ্ছে। সরকার এতকিছু সম্ভব করেছে, কিন্তু এই খুনিদের ফিরিয়ে আনতে হিমশিম খাচ্ছে। অবশ্য তারা যেসব দেশে পালিয়ে আছে, সেসব দেশের অসহযোগিতাও তাদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

১৫ আগস্ট খুনি মাজেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর