চিনের কোম্পানির কাছেও বিটিআই বিক্রি করেনি ‘বেস্ট কেমিক্যাল’
২০ আগস্ট ২০২৩ ০৯:০১
ঢাকা: ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে জৈব কীটনাশক বিটিআই (ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস) কিনেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ডিএনসিসি। আর এই বিটিআই কেনা নিয়েই বের হয়ে আসছে একের পর এক জালিয়াতির ঘটনা।
দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী সর্বনিম্ন দাম দিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে লার্ভা নিধনকারী এই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আসে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট লিমিটেড নামক এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরবরাহ করা প্যাকেটের গায়ে যে প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল সেই সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডে খোঁজ নিলে তারা জানায়, বাংলাদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিটিআই বিক্রি করেনি বলে জানায়। এমনকি চিনের কোনো কোম্পানির কাছেও এই পণ্য বিক্রি করা হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানির তথ্যে দেখা যায়, গত ২৬ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনারে করে বিটিআই ব্যাকটেরিয়া আমদানি করে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট লিমিটেড। যা চীনের ‘শানডং গানন অ্যাগ্রোকেমিক্যাল কোম্পানি’ থেকে আনা হয়েছে। চিনা কোম্পানি ‘শানডং গানন অ্যাগ্রোকেমিক্যাল কোম্পানি’র কাছেও কোনো বিটিআই বিক্রি করেনি বলে জানিয়েছে বেস্ট কেমিক্যাল।
এদিকে গত ৭ আগস্ট সিঙ্গাপুর থেকে আসা লি কিয়াং নামের এক ব্যক্তিকে বেস্ট কেমিক্যালের এক্সপোর্ট ম্যানেজার ও বিটিআই বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় ডিএনসিসি। তার নাম ও ছবি পাঠালে বেস্ট কেমিক্যাল জানিয়েছে, এই ব্যক্তি তাদের কর্মী নন এবং তারা তাকে চেনেও না।
দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি থেকে দেখা যায়, গত ১১ এপ্রিল মশার লার্ভা নিধনের উদ্দেশ্যে বিটিআই ব্যাকটেরিয়া কেনার বিজ্ঞপ্তি দেয় ঢাকা উত্তর সিটির রাজস্ব বিভাগ। এতে বিটিআইয়ের উৎপাদক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, সিঙ্গাপুর, ভারত অথবা মালয়েশিয়ার নাম ছিল। অর্থাৎ এই দেশগুলোর কোনো একটি থেকেই ব্যাকটেরিয়াটি আমদানি করতে হবে। একইসঙ্গে আমদানিকারী প্রতিষ্ঠানের অবশ্যই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের লাইসেন্স ও নিবন্ধন থাকতে হবে। কিন্তু সারাবাংলার অনুসন্ধানে দেখা যায় মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের লাইসেন্স বা নিবন্ধন কোনটিই নেই। গত ১৩ আগস্ট সারাবাংলায় এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
পরবর্তীতে সিটি করপোরেশন জানায় তারা ২ মে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং থেকে বিটিআই আমদানির জন্য লিখিত অনুমতি চাইলে তারা সেটি দেয়। মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম গণমাধ্যমে সেই অনুমতিপত্রের কপিও দেখান। এ বিষয়ে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক ফরিদুল হাসান বলেন, ‘বিটিআই আমদানির জন্য অবশ্যই লাইসেন্স লাগবে। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিটি করপোরেশনকে অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নয়।’
এদিকে জালিয়াতির বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে মেয়র আতিক বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হলে মার্শাল অ্যাগ্রোভেটকে জবাব চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে কালো তালিকাভুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। যা ১৮ আগস্ট অফিস আদেশ ঘোষণার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়।’
গত রোববার (১৪ আগস্ট) মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কোম্পানি লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদের কাছে বেস্ট কেমিক্যালের কাছ থেকে পণ্য কেনার প্রমাণ দাখিল করতে বলা হয়। গত বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) মেয়র বরাবর লেখা এক চিঠিতে অনিচ্ছাকৃত অন্যায় হয়েছে উল্লেখ করে পুরো দায়ভার তৃতীয় পক্ষের উপর চাপানো হয়। তবে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল নিশ্চিত করেছে চিনের ‘শ্যানডং গ্যানন’ তাদের পরিবেশক নয়।
বৃহস্পতিবার দেওয়া ওই চিঠিতে নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও কোন প্রমাণ বা দলিল দেখানো হয়নি। এতে বলা হয়, মশার লার্ভা নিধনে বিটিআই সংগ্রহের জন্য ঢাকা উত্তর সিটির ঘোষণা শুনে তারা বিভিন্ন দেশে মানসম্মত বিটিআই উৎপাদনকারী খুঁজতে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানির নাম পাওয়া যায় এবং প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করা হয়। তবে বেস্ট কেমিক্যালের জবাব দেওয়ার গতি ছিল অনেক ধীর। দেশে বিটিআইয়ের জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে তাই তারা অন্য কয়েকটি মাধ্যমে বেস্ট কেমিক্যালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘তখন মি. লি কিয়াং তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আমাদের জানান যে বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানি থেকে তিনি বিটিআই সংগ্রহ করে সরবরাহ করতে পারবেন। তারা লেটার অব অথোরিটি (ক্ষমতা অর্পণপত্র) দেয় এবং আমরা ই-জিপির দরপত্রে অংশ নেই। কার্যাদেশ পাওয়ার পর লি কিয়াংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং তিনি তার কোম্পানির মাধ্যমে বিটিআই সরবরাহ করেন।’
আমরা নিয়মিত তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছি এবং তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে দ্রুত প্রমাণ উপস্থাপন করবেন। আমরা শতভাগ বিশ্বাস করি যে পণ্য শতভাগ কার্যকরী ও যেকোন পরীক্ষায় তা সফলভাবে উত্তীর্ণ হবে বলেও জানানো হয় মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের পক্ষ থেকে।
আরও পড়ুন:
টেন্ডারের শর্ত লঙ্ঘন, ‘নকল’ বিটিআইয়ে জনস্বাস্থ্য নিয়ে শঙ্কা
ডিএনসিসিতে ‘নকল’ বিটিআই: আইনি ব্যবস্থা নেবে সিঙ্গাপুরের কোম্পানি
সারাবাংলা/আরএফ/এমও