বিজ্ঞাপন

টেন্ডারের শর্ত লঙ্ঘন, ‘নকল’ বিটিআইয়ে জনস্বাস্থ্য নিয়ে শঙ্কা

August 13, 2023 | 11:51 pm

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ডেঙ্গুর ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে মশার লার্ভা নিধনে ব্যাসিলাস থুরিনজিয়ানসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই) এনেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তিন মাস ধরে প্রয়োগ করার জন্য সিঙ্গাপুর থেকে এই জৈব কীটনাশক আনা হয়েছে পাঁচ টন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মশার লার্ভা নিধনে বিটিআইয়ের প্রয়োগ স্বীকৃত হলেও ডিএনসিসি যে বিটিআই এনেছে, সেটি আমদানির প্রক্রিয়া এবং তা প্রকৃত বিটিআই পণ্য কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে পণ্যটি আমদানিতে অনিয়মের নানা তথ্য।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিএনসিসিকে যে প্রতিষ্ঠানটি বিটিআই সরবরাহ করছে, তাদের এটি আনার জন্য সরকারি নিবন্ধন ও লাইসেন্স কোনোটিই নেই। অন্যদিকে সিঙ্গাপুরের যে কোম্পানির কাছ থেকে বিটিআই আনা হয়েছে বলে ডিএনসিসি দাবি করেছে, সেই বেস্ট কেমিক্যাল বলছে পণ্যটি তাদের নয়।

শুধু তাই নয়, কীটনাশক আইন অনুযায়ী দেশে প্রয়োগের জন্য কীটনাশকের প্যাকেটের গায়ে যেসব তথ্য থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, ডিএনসিসির কাছে থাকা বিটিআইয়ের প্যাকেটে সেসব তথ্য পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে কোনো ধরনের ফিল্ড টেস্ট ছাড়াই এই কীটনাশকটি প্রয়োগ শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

নিবন্ধন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই এই কীটনাশকের প্রয়োগ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কীটতত্ত্ববিদরা। ডিএনসিসির প্রয়োগ করা বিটিআই পণ্য আসল না হয়ে নকল হলে সেটিও জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে আশঙ্কা তাদের।

বিজ্ঞাপন

বিটিআই কী ও কেন

বিটিআই মূলত এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যার পুরো নাম ব্যাসিলাস থুরিনজিয়ানসিস ইসরায়েলেনসিস। এই ব্যাকটেরিয়ায় এক ধরনের স্পোর আছে, যা বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে। মশার লার্ভা এটিকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করলে সেই বিষাক্ত পদার্থের প্রভাবে মশার মিড-গাটের এপিথেলিয়াল কোষ ফুলে ফেটে যায়। এতে অন্ত্রের প্রাচীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে লার্ভা মারা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সংস্থা সিডিসি ১৯৬১ সালে বিটিআই ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে কিউলেক্স মশার ওপর বিটিআইয়ের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা হয়। জার্নাল অব মেডিকেল অ্যান্থোলজিতে প্রকাশিত সেই গবেষণার ফলাফলে একে নিরাপদ ও কার্যকর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর, ভারতেও মশা নিধনে বিটিআইয়ের ব্যবহার রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিটিআই প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, সঠিকভাবে, সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায়, নির্ধারিত সময় পরপর বিটিআই প্রয়োগ করা গেলে এডিস মশামুক্ত তথা ডেঙ্গুমুক্ত হওয়া সম্ভব। এটি মানুষের পেটে গেলেও কোনো ক্ষতি হবে না। মশা ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর কিছু হবে না। পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি করবে না।

বিটিআই এনেছে ঢাকা উত্তর সিটি

গত জুলাইয়ের শেষের দিকে মশার লার্ভা ধ্বংস করতে জৈব কীটনাশক বিটিআই প্রয়োগের কথা জানান ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। গত ৩ আগস্ট গুলশানে ডিএনসিসি নগর ভবনে এক সভা শেষে বিটিআইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। গত সোমবার (৭ আগস্ট) ডিএনসিসির অঞ্চল ৩-এর অধীন গুলশান-২-এর ৪৭ নম্বর সড়ক এলাকায় লেকে প্রথমবারের মতো এই কীটনাশক প্রয়োগও করা হয়।

ডিএনসিসির আমদানি করা বিটিআই। ছবি: সারাবাংলা

ডিএনসিসির তথ্য বলছে, তাদের জন্য সিঙ্গাপুর থেকে বিটিআই আমদানি করেছে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট লিমিটেড। বিটিআইয়ের প্যাকেটের গায়ে থাকা তথ্য অনুযায়ী এর উৎপাদক সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড। প্রতি কেজি বিটিআই তিন হাজার ৩৮৫ টাকা ২০ পয়সা দরে পাঁচ টন বিটিআই কিনতে খরচ হয়েছে এক কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা।

বিজ্ঞাপন

যা ছিল বিটিআই আমদানির দরপত্রের শর্তে

ই-জিপি টেন্ডারের মাধ্যমে বিটিআই এনেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ডিএনসিসি। কর্মকর্তারা জানান, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিউ) নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো এই দরপত্রে অংশ নেয়ার যোগ্য ছিল।

এই দরপত্রের কোনো কপি ডিএনসিসির ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি। কোন কোন পত্রিকায় কবে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছিল, সেই তথ্যও দেয়নি ডিএনসিসির জনসংযোগ বিভাগ। তবে সারাবাংলা দরপত্রের একটি কপি সংগ্রহ করেছে।

দরপত্রের কপি থেকে দেখা যায়, গত ৪ মে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য লার্ভিসাইডিংয়ের উদ্দেশ্যে বিটিআই কেনার দরপত্র বিজ্ঞপ্তি আহ্বান করে ডিএনসিসি। এতে বিটিআইয়ের উৎপাদক দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত যেকোনো দেশ, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া অথবা ভারতের নাম ছিল। এ ধরনের পণ্য ও সেবা সরবরাহে অন্তত তিন বছরের সাধারণ অভিজ্ঞতা থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল দরপত্রে অংশ নিতে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানদের জন্য। এই তিন বছরে অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠানকে বা দুইবার সাফল্যের সঙ্গে এ ধরনের পণ্য ও সেবা বিক্রির অভিজ্ঞতাও চাওয়া হয় দরপত্রে।

এ ছাড়া দরপত্রের অংশ নিতে হলে সরবরাহে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের জন্য উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের নিবন্ধন বা বিশেষ অনুমতি সনদ, আইইডিসিআরের বায়ো-এফিশিয়েন্সি রিপোর্ট এবং উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন দাখিলের শর্তও উল্লেখ ছিল।

শর্ত ভেঙে কাজ পেয়েছে মার্শাল

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএনসিসির একটি সূত্র জানিয়েছে, মে মাসের শুরুর দিকে প্রকাশিত এই ই-জিপি টেন্ডারে অংশ নেয় মার্শাল অ্যাগ্রোভেট, এমআর এন্টারপ্রাইজ ও প্রতিষ্ঠা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এদের মধ্যে সর্বনিম্ন দর দিয়ে দরপত্রটি পায় মার্শাল অ্যাগ্রোভেট, যারা প্রায় চার বছর ধরে ডিএনসিসির সঙ্গে কাজ করছে।

তবে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং থেকে পাওয়া তথ্য অনযুয়ী মার্শাল অ্যাগ্রোভেটসহ দরপত্রে অংশ নেওয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানের কোনোটিরই বিটিআই আমদানির নিবন্ধন বা লাইসেন্স নেই। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের কোনো বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।

দেশে কোনো কীটনাশক আমদানি এবং পরে তা বিক্রি ও ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স দিয়ে থাকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং। সংস্থাটি বলছে, যেকোনো ধরনের কীটনাশক আমদানি করতে হলে একটি সাধারণ আমদানি লাইসেন্স ছাড়াও প্রয়োজন হয় কীটনাশক আমদানি লাইসেন্স। তবে বিটিআই জৈব কীটনাশক হওয়ায় এটি আমদানির জন্য আগেই নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রক্রিয়া শেষ করে আলাদা লাইসেন্স প্রয়োজন হয়।

অন্যদিকে বালাইনাশক (পেস্টিসাইডস) আইন ২০১৮ অনুযায়ী, নিবন্ধিত ব্র্যান্ড ছাড়া কোনো ধরনের কীটনাশক আমদানি, বিক্রি বা মজুতের সুযোগ নেই।

জৈব কীটনাশক বিটিআই প্রসঙ্গে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের বালাইনাশক বিভাগের উপপরিচালক (প্রশাসন) ড. রফিকুল আলম খান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ইস্পাহানী ও প্রত্যাশা নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিটিআই আমদানির লাইসেন্স আছে। সেইফওয়ে, জেনেটিকা ও এঅ্যান্ডআই ইন্ডাস্ট্রিজ নামে আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।’ বিটিআই আমদানির লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের নাম নেই বলেও জানান তিনি।

এদিকে গত ৭ আগস্ট, অর্থাৎ বিটিআই প্রথম প্রয়োগের দিন উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্য আমদানি করা বিটিআইয়ের স্যাম্পল পাঠায় ডিএনসিসি। তবে কাগজপত্র ঠিক না থাকায় এটি চিঠিসহ ফেরত পাঠায় সংস্থাটি।

উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক ফরিদুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের কাছে সিটি করপোরেশন থেকে যে পণ্য পাঠানো হয়, তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় গত বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) চিঠিসহ তা ফেরত পাঠিয়েছি।

কী কাগজপত্র ছিল না জানতে চাইলে ফরিদুল হাসান বলেন, পণ্যটি কারা ও কীভাবে আনে, সেটি সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়নি। পণ্যটি আনার আগে ডিএনসিসিকে আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো এনওসি-ও (অনাপত্তিপত্র) দেওয়া হয়নি। আমাদের কাছ থেকে লাইসেন্স পাওয়া কোনো প্রতিষ্ঠান এটি আনলে আমরা পরীক্ষা করব। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আনাতে হলে এনওসি নেওয়া দরকার ছিল।

আমদানি করা বিটিআই নকল কি না!

ডিএনসিসিকে সরবরাহ করা বিটিআইয়ের প্যাকেটে কোনো ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ নেই। সেখানে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট লিমিটেড ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিকেল লিমিটেডের নাম আছে।

সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিকেল কোম্পানির ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা ইমেইল ঠিকানায় পণ্যের ছবি পাঠিয়ে ব্র্যান্ডের নাম জানতে চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, এই পণ্য তাদের নয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট লিমিটেড নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে তারা পাঁচ টন বিটিআই বিক্রি করেনি।

এদিকে গত ৭ আগস্ট সিঙ্গাপুর থেকে আগত লি কিয়াং নামক এক ব্যক্তিকে বেস্ট কেমিক্যালের এক্সপোর্ট ম্যানেজার ও বিটিআই বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় ডিএনসিসি। তার কোনো বিজনেস কার্ড পাওয়া যায়নি। তবে তার নাম ও ছবি পাঠালে বেস্ট কেমিকেল জানিয়েছে, এই ব্যক্তি তাদের কর্মী নন এবং তারা তাকে চেনেও না।

এদিকে বালাইনাশক (পেস্টিসাইডস) আইন অনুযায়ী, কীটনাশকের কনটেইনারে বা কনটেইনারের বাইরে ও খুচরা বিক্রির প্যাকেজের মোড়কে পণ্যটির পরিচয় ও বিবরণ থাকতে হবে। মার্শাল অ্যাগ্রোভেট ডিএনসিসিকে যে বিটিআই সরবরাহ করেছে, তার প্যাকেটে এই বিষয়গুলো দেখা যায়নি। বেস্ট কেমিকেলের ইমেইল উত্তর ও মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের সরবরাহ করা বিটিআইয়ের প্যাকেটের এই তথ্য ঘাটতি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, আদৌ তাদের সরবরাহ করা বিটিআই প্রকৃত বিটিআই কি না।

বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, একজন নাগরিক ও কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে আমার চাওয়া, পণ্য অনিবন্ধিত হলে যত দ্রুতসম্ভব সেটি জব্দ করে দেখা হোক আসলে সেটি কী। যে বিটিআই তারা প্রয়োগ করছে তার মোড়কের গায়ে স্ট্রেইনের উল্লেখ নেই। অথচ একেক স্ট্রেইনের টক্সিসিটি (টক্সিন প্রোফাইল) একেক রকম। তাছাড়া যেহেতু এটি অনিবন্ধিত পণ্য, তাই প্ল্যান্ট প্রোটেকশন ইউনিটও জানে না এটি আসলে বিটিআই নাকি অন্য কোনো ব্যাকটেরিয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত পরীক্ষা না হচ্ছে, আমরা এটি বুঝতেও পারবে না। যত দ্রুতসম্ভব দেখা দরকার আসলে তারা জনগণের মধ্যে কী প্রয়োগ করছে।

আরেক কীটতত্ত্ববিদ ড. সাইফুর রহমান বলেন, বিটিআই চাইলে ঘরে ঘরে দেওয়া যায়, এতটাই নিরাপদ। কিন্তু ডিএনসিসির বিটিআইয়ের মোড়কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। ফলে এতে প্রকৃত অর্থে বিটিআই রয়েছে কি না, আমরা জানি না। বিটিআইয়ের বদলে অন্য কোনো ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো পণ্য থাকলে সেটি ক্ষতির কারণ হতে পারে।

অনুমোদনের আগেই ফিল্ড টেস্ট

উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের ড. রফিকুল জানান, তাদের কাছে পরীক্ষার জন্য পণ্য পাঠালে তারা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্য সেটি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। আর পণ্যের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য পাঠান সরকারের রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর)। কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে নিজেরাও আইইডিসিআরে পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠাতে পারে।

আইইডিসিআরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৭ আগস্ট তাদের কাছে বিটিআইয়ের নমুনা পাঠিয়েছে ডিএনসিসি। সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা জানান, বিটিআইয়ের লার্ভিসাইডের কার্যকারিতা পরীক্ষার ফল পেতে সাধারণত এক সপ্তাহ সময় লাগে। আর অ্যাডাল্টিসাইডের পরীক্ষায় সময় লাগে দুদিন।

সেক্ষেত্রে ডিএনসিসির পাঠানো বিটিআইয়ের কার্যকারিতা পরীক্ষার ফল পাওয়ার কথা আনুমানিক ১৪ বা ১৫ আগস্ট। তবে ফলাফলের অপেক্ষা না করে আইইডিসিআরে নমুনা পাঠানোর দিনই বিটিআই প্রয়োগ শুরু করেছে ডিএনসিসি।

কীটতত্ত্ববিদ ড. সাইফুর বলেন, বিটিআই পরিবেশের জন্য ভালো। আমরাও অনেকদিন ধরে বিটিআইয়ের কথা বলে আসছি। কিন্তু অনেক পণ্যই অন্য দেশে কাজ করলেও আমাদের দেশে নাও কাজ করতে পারে। তাই পণ্যটি যখন দেশে এসেছে, ভালোভাবে এফিকেসি টেস্ট করে তার ফলাফলের ভিত্তিতেই এটি প্রয়োগ করা উচিত।

লেকে ফিল্ড টেস্ট নিয়েও প্রশ্ন

ঢাকা উত্তর সিটি প্রথম বিটিআই প্রয়োগ করে গুলশান-২ এলাকার লেকে। আইইডিসিআর বা অন্য কোথাও বিটিআইয়ের ‘এফিকেসি টেস্ট’ তথা কার্যকারিতা পরীক্ষার ফলাফল না মিললেও তারা প্রথম প্রয়োগকে ‘ফিল্ড টেস্ট’ হিসেবে অভিহিত করছে। তবে ফিল্ড টেস্ট হিসেবে লেকে বিটিআই প্রয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কীটতত্ত্ববিদরা।

বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, লেকে তো এডিস মশাই হয় না, সেখানে কীভাবে ফিল্ড টেস্ট হয়? যদি অন্য মশার লার্ভা মারত হয়, তার তো এখন প্রয়োজন নেই। কারণ এখন একমাত্র অগ্রাধিকার হওয়া প্রয়োজন ডেঙ্গু। ফিল্ড টেস্টের কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। সেখানে এডিস মশা ছিল কি না, থাকলেও কতগুলো ছিল- এগুলো জেনে তারপর বিটিআই প্রয়োগ করে পরের তথ্য নিয়ে ফিল্ড টেস্টের সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে।

কীটতত্ত্ববিদ ড. সাইফুর রহমান বলেন, এডিস মশার লার্ভা মারার জন্য এনে থাকলে লেকে ফিল্ড টেস্ট করার যৌক্তিকতা নেই। লেকে কিউলেক্স মশা হয়, এডিস মশা না।

উত্তর নেই ডিএনসিসি ও মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের

কীটনাশকের নিবন্ধন বা আমদানির লাইসেন্স না থাকা প্রতিষ্ঠানের জৈব কীটনাশক বিটিআই সরবরাহ করা; দরপত্রে অংশগ্রহণকারীদের শর্ত লঙ্ঘন; সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিকেলের বাংলাদেশে মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের কাছে বিটিআই বিক্রির তথ্য অস্বীকার; কার্যকারিতা পরীক্ষার আগেই বিটিআইয়ের প্রয়োগ; প্রথম প্রয়োগকে ফিল্ড টেস্ট বললেও কেন সেটি লেকের পানিতে- এসব বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গত ৮ আগস্ট সিটি ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বরাবর লিখিত প্রশ্ন পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি তিনি।

অন্যদিকে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট লিমিটেডের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা মোবাইল নম্বরে দফায় দফায় ফোন ও এসএমএস দিলেও তাদের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়। কিন্তু ডিএনসিসি যে প্রক্রিয়ায় কাজটি (বিটিআই আমদানি) করেছে, তা আপাদমস্তক প্রতারণামূলক ও দুর্নীতিগ্রস্ত। কারণ এতে রাষ্ট্রীয় খাতে কেনাকাটার প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করার আলামত আছে।

তিনি আরও বলেন, পণ্যটির যথার্থতা ও প্রযোজ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি প্রতারণামূলকভাবে কেনাকাটার প্রশ্নও রয়েছে। কারণ যে প্রতিষ্ঠানের পণ্য কেনা হয়েছে বলে বলা হয়েছে, তারা অস্বীকার করছে। কাজেই এখানে আপাদমস্তক প্রতারণা ও দুর্নীতি ঘটেছে। এখানে যারা কেনাকাটা ও বাস্তবায়নে যুক্ত, কেবল তারাই প্রতারণা ও দুর্নীতিতে জড়িত, তা বললে চলবে না। এখানে ডিএনসিসির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এমন একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এ ধরনের প্রতারণামূলক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। কাজেই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের সবার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন