বর্ষায় কমেনি বায়ুদূষণ, অব্যাহত শরতেও
২৬ আগস্ট ২০২৩ ২৩:৪৭ | আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২৩ ১১:৫৭
ঢাকা: সাধারণত শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে শীত ও গ্রীষ্মকালে বায়ুদূষণ বেশি হয়। আর বর্ষায় বৃষ্টিপাত হলে দূষণ কমে যায়। কিন্তু এবার ভরা বর্ষায়ও রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ ছিল ঊর্ধ্বমুখী, যা এই শরতেও চলমান। চলতি বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হলেও প্রায় প্রতিদিনই বায়ুদূষণের বিভিন্ন সূচকে উপরের দিকেই ছিল রাজধানী ঢাকা। বিশেষজ্ঞরা বর্ষায় এই দূষণের জন্য ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বৃষ্টির ধরন পরিবর্তন ও বেপরোয়া নির্মাণ ও পরিবেশ অধিদফতরের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করছেন।
শনিবার (২৬ আগস্ট) সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈশ্বিক বায়ুমান পরিমাপক সূচক ‘আইকিউএয়ার’ অনুযায়ী ঢাকার বায়ুমান সূচক ১৩০ যা সেনসেটিভ গ্রুপের জন্য অস্বাস্থ্যকর। গত এক মাসের চিত্র বিশ্লেষণ করেও ঢাকার বায়ু একদিনের জন্যেও ভালো দেখা যায়নি। সবচেয়ে ভালো অবস্থাতেও এটি ছিল ‘মধ্যম’ মানের। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্তও দূষণমান ঊর্ধ্বমুখীই দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলোন বাপা’র সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে তিনটি কারণে ঢাকার বায়ুদূষণ ঘটছে। প্রথমত, অল্প বৃষ্টিতে জলজট হয়ে ময়লা ও কাদা উপরে উঠে আসছে। পরবর্তী সময়ে পানি নেমে গেলে এই কাদা শুকিয়ে গাড়ির চাকার চাপে উড়তে থাকে। এখন লাগাতার কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি না হয়ে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে কাদা শুকিয়ে গাড়ির চাকার মাধ্যমে দূষণ বাড়াচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বর্ষা ও শরতে জলীয় বাষ্পের একটি আবরণ আমাদের ঢেকে রাখে। ফলে একধরনের ফিউম তৈরি হয়। যা অন্য সময়ে উপরের দিকে চলে গেলেও এখন নিচের দিকে একটি আবরণ সৃষ্টি করে রাখে। এতে দূষণ আটকে থাকছে। আর তৃতীয় কারণ হলো- যানজট। যানজটের কারণে গ্যাসের উদগীরণ বাড়ে, যা দূষণ বাড়ায়। সবকিছু মিলিয়ে বর্ষায়ও বায়ুদূষণের ভয়াবহতা বেড়েছে।’
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)’র প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বর্ষায় বায়ুদূষণের দুটি প্রধান কারণ উল্লেখ করেছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর জুন-জুলাই-আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দূষণ অনেক কম দেখা গেলেও এ বছর জুন-জুলাইয়েও দূষণের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। এর কারণ, ফিটনেসবিহীন যান চলাচল বৃদ্ধি ও বড় বড় প্রকল্পগুলোর চলমান কাজ। এতে রাজধানীতে ধূলার পরিমাণ বেড়েছে, যা বৃষ্টির সময় রাস্তায় চলে আসছে। পরে সেই কাদা শুকিয়ে ধূলায় পরিণত হয়ে যানবাহনের চাকার মাধ্যমে বাতাসে মিশে যাচ্ছে।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলের জন্য দূষণ বেড়েছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি সংখ্যায় কমার বদলে দিনদিন বেড়েই চলছে। রাজধানীর বিভিন্ন ফ্লাইওভারে ওঠার জায়গায় ১০ মিনিট দাঁড়ালে যানবাহনগুলোর ফিটনেস না থাকার বিষয়টা বোঝা যায়। ১০ মিনিটে অন্তত পাঁচটা বাস পাওয়া যাবে যাদের ফ্লাইওভারে ওঠার ক্যাপাসিটি পর্যন্ত নাই। ফলে ওই স্থানে প্রচুর ধোঁয়া উৎপন্ন। এতে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ে। এ ছাড়া মেট্রোরেলের ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ, এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজার কাজ এবং পানি ও গ্যাসলাইনের জন্য বিভিন্ন রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এমনকি ঈদের আগে তৈরি হওয়া কাদাও এখন পর্যন্ত অপসারণ করা হয়নি। নির্মাণকাজে সমন্বয়হীনতার জন্য এখন প্রচুর ধূলা দেখা যাচ্ছে। ফলে বর্ষা শেষে শরতেও রাজধানীর বায়ুমান চরম অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
সমাধানের উপায় নিয়ে ইকবাল হাবিব বলেন, ‘প্রতিবার বর্ষণের পর নগরী জল দিয়ে পরিষ্কার করা উচিত। যানজট কমানোর জন্য ব্যক্তিগত যানবাহন কমাতে হবে। এর জন্য জরুরি ভিত্তিতে গণপরিবহনমুখী জরুরি প্যারাডাইম শিফট নির্মাণ করতে হবে।’
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদফতরের কার্যক্রম যথেষ্ট মনে করেন কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘তাদের কাজ যে যথেষ্ট নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা কাজ করলে তো এই অবস্থা তৈরি হতো না। এত মানুষের একটা শহরে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। এভাবে তো চলতে পারে না।’ মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকাটাও বড় অসহায়ত্ব বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যক্তিগত গাড়ি উপর নির্ভরতা অনেক বেশি। ইনক্লুসিভ চিন্তার অভাব। সমাধানের জন্য আমাদের অবশ্যই সবার কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
এমন পরিস্থিতিতে দূষণ কমাতে অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সমন্বয় করতে কী উদ্যোগ নিচ্ছে- জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্তঃমন্ত্রণালয় ও আন্তঃসংস্থা সমন্বয়ের জন্য বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০২২ এর আলোকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি কাজ করছে। ইতোমধ্যে একটি সভা করে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া করেছে। এগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের বিষয়ে তদারকি করা হচ্ছে।’
আইকিউএয়ার’র ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই বছর থেকেই বায়ুদূষণে টানা শীর্ষে বাংলাদেশ। আর রাজধানী ঢাকা দ্বিতীয় অবস্থানে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর ছয় মাস হলেও এক গবেষণায় দেখা গেছে টানা দূষণের ফলে মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে। ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’ অনুযায়ী বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। আর রাজধানী ঢাকায় এটি প্রায় সাত বছর সাত মাস।
আইকিউএয়ার’র হিসাব অনুযায়ী, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) যদি শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে ওই বাতাসকে বায়ুমান সূচকে (একিউআই) ‘ভালো’ বলা যায়। এই মাত্রা ৫১-১০০ হলে বাতাসকে ‘মধ্যম’ মানের এবং ১০১-১৫০ হলে ‘বিপদসীমায়’ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর পিপিএম ১৫১-২০০ হলে বাতাসকে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১-৩০০ হলে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১-৫০০ হলে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। দূষণ পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে জনসাধারণকে নানারকম সচেতনতা মেনে চলতে হয়। মাস্ক ব্যবহার, এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার, নির্দিষ্ট রোগ থাকলে বাইরে না যাওয়া, খেলাধুলা না করা ইত্যাদি।
সারাবাংলা/আরএফ/পিটিএম