সাজা শেষ, তবু মুক্তির অপেক্ষায় বছরের পর বছর পার
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:২৫
যশোর: যশোর জেলা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ৩৪ ভারতীয় নাগরিকের মুক্তিকে বাধ সেধেছে আইনি জটিলতা। সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বছরের পর বছর তাদের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে মুক্তির জন্য। এক বন্দির সেই অপেক্ষা এক যুগ ছোঁয়ার পথে। কারাগারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অবহেলা বা যথাযথ সাড়া না পাওয়ার কারণেই এসব বন্দির মুক্তির আইনি প্রক্রিয়া থমকে আছে।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এখানে যেসব ভারতীয় বন্দি আছেন তাদের মধ্যে ৩৪ জনের সাজা শেষ হয়েছে। তাদের একজন নারী, বাকি ৩৩ জন পুরুষ। সাজা শেষ হওয়ায় মুক্ত জীবনে ফিরতে তাদের আইনি বাধা নেই। তবে ভিনদেশি হওয়ায় তারা কারাগার থেকে সরাসরি মুক্তি পাবেন না। নিয়ম অনুযায়ী তাদের সীমান্তে হস্তান্তর করতে হবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে।
কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পাওয়ার পর ৩৪ বন্দিকে ভারতে ফেরত পাঠাতে যশোর ঝুমঝুমপুরের ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নকে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। নিয়ম অনুযায়ী এরপর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সঙ্গে আলোচনা করে বন্দি হস্তান্তরের দিনক্ষণ নির্ধারণ করবে বিজিবি। ওই দিনে বেনাপোল সীমান্তে কারা কর্তৃপক্ষ বন্দিদের হস্তান্তর করবে বিজিবির কাছে। এরপর বিজিবি তাদের তুলে দেবে বিএসএফের কাছে। কিন্তু এসব প্রক্রিয়ার কোনোটিই আর এগোয়নি। এমনকি যশোর কারা কর্মকর্তারা ভারতীয় কনস্যুলার অ্যাটাশের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া পাননি।
কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, ভারতীয় একজন বন্দি বিহার প্রদেশের গোবিন্দ বিহারীর সাজার মেয়াদ শেষ হয় ২০১২ সালের শুরুতে। এরপর গত ১১ বছরেও তাকে আর দেশে ফেরত পাঠানো যায়নি। সাজা খাটার পরও তার মুক্তির অপেক্ষার যুগপূর্তি হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে সাজা শেষ করে সর্বশেষ মুক্তি পাওয়ার উপযোগী হয়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলার মিনারুল। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তার সাজা শেষ হয়েছে।
গোবিন্দ ও মিনারুলসহ এরকম ৩৪ জন বন্দিকে নিজ দেশ ভারতে ফেরত পাঠাতে কারা কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালালেও লাভ হচ্ছে না। বিএসএফের কাছ থেকে তাদের গ্রহণের দিন-তারিখ মিলছে না। ফলে তারা বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। বিষয়টি যশোর জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির কয়েকটি সভাতেও আলোচনা হয়েছে এবং ব্যবস্থা নিতে বিজিবির প্রতিনিধিকে জানানো হয়েছে।
বন্দিদের নিয়ে আইনি জটিলতা প্রসঙ্গে কারাগারের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, গত ২৮ এপ্রিল ভারতীয় হাইকমিশনের কনস্যুলার অ্যাটাশে দেবব্রত চক্রবর্তী যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে আসেন। তিনি মাত্র চারজন বন্দির ভারতের ঠিকানা শনাক্ত করতে সক্ষম হন। সেই চারজনকেও কারাগার থেকে মুক্ত করে দেশে ফেরানোর কোনো পদক্ষেপ তিনি নেননি। জেল কর্তৃপক্ষ কয়েক দফা তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও অগ্রগতি হয়নি।
এসব বন্দির ভারতের ঠিকানা শনাক্ত করা নিয়ে কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেন, বেশির ভাগ বন্দি কারাগারে আসার সময় যে নাম-ঠিকানা ব্যবহার করেন, পরে তাদের দেওয়া ঠিকানার সঙ্গে আগের ঠিকানার মিল পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, কোনো ঠিকানাতেই বন্দির স্বজনদের সঙ্গে যোগযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে আবার কোনো ঠিকানাই বলতে পারেন না।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার শংকর কুমার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ৩৪ জন বন্দির সাজা শেষ হয়েছে। তাদের মুক্তির নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে যে চিঠি কারা কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে, একই চিঠির অনুলিপি বিজিবি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভারতীয় হাইকমিশন পেয়ে থাকে। তবু আমরা নিয়ম অনুযায়ী ৪৯ বিজিবি ব্যাটেলিয়ানকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। তারা বিএসএফের কাছ থেকে কোনো সাড়া পায়নি বলে জেনেছি।
এদিকে যশোর ৪৯ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আহমেদ জামিল চৌধুরী এ ধরনের কোনো চিঠি পেয়েছেন বলে স্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘এরকম কোনো চিঠি পাইনি। তাই বিস্তারিত কিছু বলতে পারব না।’
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) সুরাইয়া আক্তার বলেন, ৩৪ জনের মধ্যে দুজনের মুক্তির সব ধরনের প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ। শুধু তাদের ফের পাঠানোর কোনো তারিখ পাওয়া যাচ্ছে না। যশোর কারা কর্তৃপক্ষ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো ব্যক্তি পর্যায়েও এই চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে কারা উপমহাপরিদর্শক অসীম কান্ত পাল বলেন, ভারতসহ বিদেশি কোনো বন্দির সাজা শেষ হওয়ার আগেই কারা কর্তৃপক্ষ প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কারা অধিদপ্তর ও পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। নানা প্রক্রিয়া ও আইনি বিধান শেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলে সংশ্লিষ্ট কারাগার পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়। যেহেতু বিষয়টির সঙ্গে দুটি দেশ যুক্ত, তাই কিছু সমস্যা হয়। সাজার মেয়াদ শেষ হলেও যশোর কারাগারে ভারতীয় কয়েজন দীর্ঘদিন রয়েছেন। কিন্তু সাজা শেষ হওয়ার পর আমরা কাউকে জেলখানায় রাখতে চাই না। আমরা চাই, তারা মুক্ত জীবন উপভোগ করুক।
এদিকে এই ৩৪ জন ছাড়াও যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত আরও দুই ভারতীয় নাগরিক রয়েছেন। তামিলনাড়ুর সাউল হামিদ ও নদীয়ার গাজী মন্ডল নামের ওই দুই ভারতীয় ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। অন্যদিকে আরও ১০ ভারতীয় হাজতি রয়েছেন, যাদের মধ্যে দুজনের মামলা বিচারাধীন। ভারতীয় ছাড়াও একজন নেপালি নাগরিকও বন্দি আছেন যশোর কারাগারে।
কারা সূত্র বলছে, ভারতীয়সহ বিদেশি বন্দিদের ক্ষেত্রে ভাষার কারণে সমস্যা ও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সমস্যা হয় কাজকর্মে ও অসুস্থতায়। এ ছাড়া অনেকেই দীর্ঘদিন কারাঅভ্যন্তরে থাকতে থাকতে স্মৃতিশক্তির সমস্যায় ভোগেন। অনেকের আচরণে কিছুটা ভারসাম্যহীনতাও দেখা দেয়।
সারাবাংলা/টিআর