৪ কারণে নিউ মার্কেটে জলজট, একদিনে ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:০৪
ঢাকা: গত বৃহস্পতিবারের বৃষ্টির পর রাজধানী ঢাকার প্রায় প্রতিটি এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয় কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেই পানি নেমে গেলেও চব্বিশ ঘণ্টা পানির নিচে থাকে ঢাকা নিউ মার্কেট। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় এর পেছনে রয়েছে চার কারণ। সেগুলো হলো ড্রেন পরিষ্কার না থাকা, পলিবর্জ্য, ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের গ্লাস ও কাপ, ককশিটসহ অন্যান্য বর্জ্যে ড্রেন ও মেইনটেনেন্স পিট আটকে যাওয়া; নিউ মার্কেটের অবস্থান রাস্তা থেকে নিচে হওয়ায় রাস্তার পানি চলে আসা; কবরস্থানের পানি গড়িয়ে আসা এবং নিউ মার্কেট এলাকা থেকে কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধ হয়ে পানি বেরিয়ে যাওয়ার পথ আটকে থাকা। ব্যবসায়ীদের দাবি— এই জলজটের কারণে একদিনে নিউ মার্কেটে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০ কোটি টাকা।
তিরিশ বছর ধরে নিউ মার্কেটে ব্যাগের ব্যবসা করেন মোহাম্মদ ইসমাইল খলিল। তিরিশ বছরের মধ্যে নিউ মার্কেটে এভাবে পানি জমতে দেখেননি তিনি। মামুন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইসমাইল খলিলের দোকানে থাকা ব্যাগ ভিজে ক্ষতি হয়েছে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। এ ছাড়া কিছু ভেজা ব্যাগ শুকিয়ে অল্পদামে বিক্রি করলে এ ক্ষতি দাঁড়াবে প্রায় দশ লাখ টাকা।
বিশ বছর ধরে নিউ মার্কেটে ভাসমান দোকান চালান মো. নূর ইসলাম। তৈরি প্যান্ট ট্রাউজার্স বিক্রি করেন তিনি। এর আগে এমন দুর্যোগ আর দেখেননি। তার ক্ষতিও প্রায় হাজার বিশেক টাকা। নিউ মার্কেটের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত নিউ সুপার মার্কেটে ক্রোকারিজের দোকান রয়েছে মোহাম্মদ টিটু’র। বৃহস্পতিবারের বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতার কারণে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে তার। আরেক ক্রোকারিজ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহীনের ক্ষতিও প্রায় এক লাখ টাকা। কাঠ, বাঁশের হ্যান্ডিক্রাফটের দোকানমালিক মোহাম্মদ নূর আলমের ক্ষতি পঞ্চাশ হাজার টাকা।
এভাবে দুই মার্কেটের এক হাজার সাতশ দোকান ও দুইশ ভাসমান বিক্রেতার কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে একদিনের জলাবদ্ধতায়। ঢাক নিউ মার্কেট ও নিউ সুপার মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দুই মার্কেট মিলিয়ে ক্ষতি ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার। এছাড়াও চব্বিশ ঘণ্টা বন্ধ থাকায় দুই মার্কেট মিলিয়ে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা।
নিউ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক জানান, তাদের মার্কেটে ৫০০ দোকান ও ১২০/৩০ জন হকার। কমবেশি সব দোকানই ক্ষতিগ্রস্ত। পানিতে দোকানে থাকা আসবাব ও পণ্য নষ্ট হয়ে একদিনে তাদের ক্ষতির পরিমাণ ২০/২৫ কোটি টাকা। এ সব দোকানদের সরকারের তরফ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণের আশ্বাস পাওয়া যায়নি। সমিতি শুক্রবার নিউ মার্কেটের বেচাকেনা ২০ কোটি টাকার কেনাবেচা বন্ধ থাকে।
নিউ সুপার মার্কেটের সেক্রেটারি আমিনুল ইসলাম সাগর জানান, তাদের মার্কেটে দোকান ১২০০ এবং হকার আছে ৫০ থেকে ৬০ জন। একদিনে ক্ষতি হয়েছে দশ কোটি টাকার মতো। অন্যদিকে শুক্রবার বন্ধ থাকায় এদিন তাদের মার্কেটে ৩০ কোটি টাকার মতো বেচাকেনা হয়নি।
রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পুরো নিউ মার্কেটজুড়েই এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভেজা জিনিসপত্র শুকাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এমন দুর্যোগ তারা আর দেখেননি। কীভাবে এই ক্ষতি সামলে উঠবেন জানেন না। পানি জমার কারণ হিসেবে সবাই জানালেন অতিবৃষ্টি, অপরিষ্কার ড্রেন, রাস্তা ও আশপাশের অন্যান্য উঁচু জায়গা থেকে অপেক্ষাকৃত নিচু নিউ মার্কেট চত্বরে পানি আসা এবং যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলা।
নিউ মার্কেটের নিয়মিত কেনাকাটা করতে আসেন বেসরকারি চাকরিজীবী মো. জামাল মিয়া। ড্রেনে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের গ্লাস এবং অন্যান্য বর্জ্য দেখিয়ে বললেন, এরকম ড্রেন থাকলে কীভাবে পানি যাবে বলেন। পুরো মার্কেটে ডাস্টবিনও চোখে পড়ে না যেখানে ময়লা ফেলব। ড্রেনের মধ্যে যেভাবে আমরা প্লাস্টিক পণ্য ফেলছি তাতে এমন কিছু ঘটারই কথা ছিল। সিটি করপোরেশন আর কত পরিষ্কার করবে?
এদিকে নিউ মার্কেটের ভেতরে ম্যানহোলের মুখ নাকি গত বিশ বছরেও খুলতে দেখেননি ব্যবসায়ী নুর ইসলাম। কিন্তু নিউ মার্কেট ও নিউ সুপার মার্কেটের দোকান মালিক সমিতি বলছেন, দুই মার্কেট মিলিয়ে রয়েছে আলাদা পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও সুইপার। ময়লা নিয়ে জমা রাখলে সেগুলো সংগ্রহ করে সিটি করপোরেশন। ময়লা নেওয়ার জন্য দোকানপ্রতি দিতে হয় ৩০০ টাকা। অর্থাৎ দুই মার্কেট মিলিয়ে ভেতরের ময়লা সংগ্রহের জন্য ১ হাজার সাতশ দোকান থেকে দেওয়া হয় ৫১ হাজার টাকা। কিন্তু তারপরও বন্ধ ড্রেন। জলাবদ্ধতার পর কয়েক ট্রাক ময়লা সরানোর পরও এখনো জমে আছে পলিথিন আর ওয়ানটাইম গ্লাসসহ অন্যান্য আবর্জনা।
এদিকে সিটি করপোরেশন বলছে তারা বছরে একবার ড্রেন পরিষ্কার করে। কিন্তু ড্রেন ও পিট থেকে বের হওয়া বর্জ্যের পরিমাণ বলছে এখানে ঘাটতি আছে উভয় পক্ষেরই। নিয়মিত পরিষ্কার করা হলে এমন জলাবদ্ধতা দেখা দিতো না।
নিউ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক বলেন, ‘মার্কেটে ১০০টি বিন রয়েছে কিন্তু বৃষ্টির পানিতে সেগুলো ভেসে গেছে। তাদের মার্কেটের জন্যই আছে ৮ জন সুইপার। প্রতি মঙ্গলবার মার্কেটের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এটি পরিষ্কার করা হয়। তারপরেও ড্রেনে এত ময়লা জমে বন্ধ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।’
নিউ সুপার মার্কেটের সেক্রেটারি আমিনুল ইসলাম সাগর জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে অতিরিক্ত বৃষ্টি আর ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেন। দুই ট্রাক পলিথিন, ওয়ান টাইম গ্লাস। চার্টি পিট থেকে পলিব্যাগ, ওয়ানটাইম গ্লাস, ককশিটসহ অন্যান্য ময়লা পাওয়া গেছে দুই ট্রাক। এসব কারণেই নিউ মার্কেট থেকে পানি সরতে পারেনি। এই মার্কেটের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছয়জন। এ ছাড়া নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌ. (পুর) মো. খায়রুল বাকের নিউ মার্কেটের জলাবদ্ধতার তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। এক, ১০/১৫ বছরের মধ্যে এত বৃষ্টিপাত হতে দেখা যায়নি। বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিপাত হয়েছে। ছয়ঘণ্টা ধরে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তা যদি ১২ ঘণ্টা ধরে হতো তাহলে এমনটি হতো না।
ড্রেনেজে লাইন ও মেইন্টেনেন্স পিটে জমে থাকা কঠিন বর্জ্য। মূলত প্রচুর পরিমাণ পলিবর্জ্য, বোতল এবং ডাবের খোসার মতো কঠিন বর্জ্য জমে থাকায় পানি সরতে পারেনি। পিট থেকে প্রচুর বর্জ্য পাওয়া গেছে এবং তিন, নিউ মার্কেট এলাকা থেকে পানি সরার যে দুটি নর্দমা ছিল তা বন্ধ থাকা।
পানি চলাচলের পথ রুদ্ধ থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবির ভেতরে চারপাশ দিয়ে জলাশয় ছিল যা এখন বন্ধ আছে। নিউ মার্কেট থেকে দুটি লাইন দিয়ে এখানে পানি যেত। সেদিনের বৃষ্টিপাতে বিজিবির ভেতরেও পানি জমে ছিল।’ তবে কবে থেকে এটি বন্ধ বা কেন বন্ধ করা হয়েছে তা জানাতে পারেননি তিনি।
জানা যায়, নিউ মার্কেট এলাকা থেকে ঢাকা কলেজের সামনে দিয়ে নায়েম রোডের ওদিক দিয়ে একটি নালা ছিল যা দিয়ে পানি চলে যেতে বিজিবি এলাকায়। আরেকটি ছিল নিউ মার্কেট থেকে বিজিবির তিন নম্বর গেট দিয়ে বিজিবি সিনেমা হল দিয়ে যেত। বৃহস্পতিবারের বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতার ঘটনায় দেখা গেল দুটি পথের একটিও সচল নেই। তাদের ধারণা, ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের পর নিরাপত্তাজনিত কারণে এসব লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এটির সমাধানে এরইমধ্যে বিজিবি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি। গত জুলাই মাসে ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপসের সভাপতিত্বে হওয়া ওই মিটিংয়ে পানি চলাচলের রাস্তা সচল বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা যৌথ পরিদর্শনও করেছি। কিছুদিনের মধ্যে লাইনগুলো ছোটানো হবে বা নতুন লাইন তৈরি করা হবে।
এদিকে ড্রেন পরিষ্কার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বছরে একবার আমরা ড্রেন পরিষ্কার করি। নিউ মার্কেটের আশপাশের ড্রেনও গতবছর পরিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু বিজিবি এলাকার মধ্যে পরিষ্কার করার এখতিয়ার আমাদের নেই। আশা করছি, দ্রুত এটি ঠিক করা হবে।’
সারাবাংলা/আরএফ/একে