খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে অশনী সংকেত
২ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:০১
ঢাকা: একদিকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, অন্যদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়াকে দেশের অর্থনীতির জন্য অশনী সংকেত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, ঋণ আদায়ে কঠোর না হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানাধরনের ছাড় দেওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকার নতুন রেকর্ড গড়েছে।
এদিকে, চলমান ডলার সংকটের মধ্যে সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে। এই অবস্থায় দেশের ডলার সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করবে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, ডলার সংকটের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান সময় মতো এলসি খুলতে পারছে না। কার্ব মার্কেটে ডলারের রেট বাড়ছে। সেইসঙ্গে কমছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ। এই অবস্থায় রেমিট্যান্স কমে গেলে অর্থনীতি আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ত পারে।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় না করে বরং একের পর এক সুবিধা দেওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে। খেলাপি ঋণ নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য শুভ সংবাদ না। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ভবিষ্যতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে বিনিয়োগ কমে যাবে। আর বিনিয়োগ কমলে কর্মসংস্থান হবে না।’
অন্যদিকে, রেমিট্যান্স কমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণ করে দেওয়ায় বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডিতে বেশি টাকা দেশে আসছে। কারণ হুন্ডিতে টাকা পাঠালে বেশি লাভ পাচ্ছে। আর এই কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। যা অর্থনীতিতে চাপ বাড়াবে।’
হুন্ডি বন্ধে সরকারের করণীয় জানতে চাইলে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ডলার এক্সচেঞ্জ রেট ফ্রি করে দিতে হবে। অন্যথায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘একের পর এক ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক ব্যাংকে তারল্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাংকখাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমছে।’
রেমিট্যান্স কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স কমার প্রধান কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক একেক সময় একেক কথা বলে। কখনো বলে রেমিট্যান্সের ওপর শতকরা দুই টাকা বেশি দেবো। কখনো বলে তিন টাকা বেশি দেবো। বাংলাদেশ ব্যাংকের একেক সময়ে একেক সিদ্ধান্তের প্রতি সাধারণ মানুষের কোনো আস্থা নেই। ফলে সাধারণ মানুষ মনে করে আমি হুন্ডিতে টাকা পাঠাবো, টাকাও বেশি পাব এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবে। যদিও এটা বেআইনি। আবার ব্যাংকে টাকা পাঠালে নানা ধরনের জবাবদিহিতা করতে হয়। এই ব্যাংক থেকে সেই ব্যাংকে যেতে হয়। ফলে মানুষ ঝামেলা এড়িয়ে চলে।’
তিনি বলেন, ‘আবার ইউরোপ-আমেরিকাতে যেসব উচ্চ শিক্ষিত নাগরিক রয়েছেন তারাও দেশে টাকা পাঠান। তারা এখন মনে করছেন, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ভালো না। এই সময়ে টাকা পাঠালে উল্টো ঝামেলা হতে পারে। এসব কারণে বর্তমানে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে।’
উল্লেখ্য, রোববার (১ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, এ বছরের জুন পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। মোট যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল, খেলাপি ঋণ তার ১০ দশমিক ১১ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) শেষ তিন মাস তথা এ বছরের এপ্রিল থেকে জুনে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা।
এদিকে, সদ্য বিদায়ী সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। এটি গত সাড়ে তিন বছর বা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে, ২০২০ সালের এপ্রিলে প্রবাসীরা ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিল। এরপর গত সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স আসে।
সারাবাংলা/জিএস/পিটিএম