বেনামি সিম কার্ডে লেনদেন ও হুন্ডিতে জুয়ার অর্থপাচার
২৪ অক্টোবর ২০২৩ ২০:৪৫
ঢাকা: প্রচলিত বিদেশি অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপস বিটিআরসি বন্ধ করলেও ডোমেইন পরিবর্তন করে কৌশলে পুনরায় সাইট ও অ্যাপস চালু করা হচ্ছে। অন্যের তথ্যে ও বেনামি একাধিক সিমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে হচ্ছে লেনদেন। জুয়ার লেনদেনের লভ্যাংশের বাইরে অবশিষ্ট টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠাচ্ছে চক্রের সদস্যরা।
মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে বিদেশ থেকে পরিচালিত বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটের কার্যক্রম দেশে পরিচালনায় জড়িত চক্রের অন্যতম মূলহোতা নিশাত মুন্নাসহ চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার পর এ তথ্য জানায় র্যাব। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে তিন জন হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শুভ (২৭), মো. সুমন (৩৫) ও নাজমুল হোসেন বাবু (৩১)।
এর আগে, সোমবার (২৩ অক্টোবর) দিবাগত রাতে গাজীপুরের শ্রীপুর ও রাজধানীর মালিবাগ হতে তাদের গ্রেফতার করে র্যাব-১ ও র্যাব-১১ যৌথ দল। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৬টি মোবাইল ফোন, ১৮টি সিম কার্ড, একটি সিপিইউ, একটি মনিটর জব্দ করা হয়। র্যাব বলছে, তারা অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্ধকোটি টাকার বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারদের অনলাইন জুয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে উল্লেখ করে কমান্ডার মঈন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘দেড় বছর ধরে চক্রটি বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটের বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে জড়িত। দেশের বাহির থেকে পরিচালিত বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটের দেশীয় কার্যক্রম পরিচালনার অন্যতম মূলহোতা গ্রেফতার নিশাত মুন্না। এ ছাড়া গ্রেফতার অন্যরা বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটের কার্যক্রম দেশে পরিচালনার সঙ্গে জড়িত।’
কমান্ডার মঈন বলেন, ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) কর্তৃক অনলাইন জুয়া বা বাজিসংক্রান্ত বিভিন্ন অ্যাপস এবং ওয়েবসাইট ইতোপূর্বে বন্ধ করা হলে তারা ডোমেইন পরিবর্তন করে পুনরায় অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে জুয়া চালু করে। তারা নামে বেনামে একাধিক সিম সংগ্রহ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে অনলাইনে জুয়ার অর্থ সংগ্রহ করতো। প্রাপ্ত অর্থ থেকে নিজেদের লভ্যাংশ রেখে অবশিষ্ট টাকা তারা হুন্ডির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশে অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্ম পরিচালনাকারীর কাছে পাঠাতো বলে জানায়।’
বেটিংয়ের প্রতি ভিডিও প্রচারে নিশাত মুন্না নিতো ১০ হাজার টাকা
গ্রেফতার নিশাত মুন্না সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন অনলাইন বেটিং সাইটের দেশীয় কার্যক্রম পরিচালনার অন্যতম মূলহোতা মুন্না। সে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তড়িৎ প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়নরত। তিনি নিশাত মুন্না নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল এবং নিশাত মুন্না (সাইলেন্ট কিলার) নামে একটি ফেইসবুক আইডি খুলে বিভিন্ন রোস্টিং/বিতর্কিত ভিডিও তৈরি করে প্রচার করত। দেড় বছর আগে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি গ্রুপের বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখে আসক্ত হয়। এর পর তার অনলাইনের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বেটিং সাইট প্রসারের জন্য ভিডিও বানাতে তাকে দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পরে তিনি অধিক অর্থ লাভের আশায় বিভিন্ন বেটিং সাইটের প্রচার ও অন্যান্য কার্যক্রমে জড়ায়। তিনি তার ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুকে তার তৈরিকৃত ভিডিওতে বিভিন্ন অনলাইন জুয়া সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন। মুন্না তার প্রতিটি ভিডিওতে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ১০ হাজার করে টাকা নিতেন।
লোভে মোবাইল কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি কামরুল জড়ায় জুয়ায়
গ্রেফতার কামরুল স্নাতক শেষ করে একটি মোবাইল কোম্পানির সেলস রিপ্রেসেন্টেটিভ হিসেবে কাজ করতেন। দেড় বছর আগে গ্রেফতার নিশাতের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হয় তার। পরে তিনি নিশাতের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি স্বল্প সময়ে অধিক অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন পরিচিত লোকদের অনলাইন জুয়ার সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলতে উদ্বুদ্ধ করতেন এবং আগ্রহী ব্যক্তিদের অনলাইন জুয়ার বিভিন্ন সাইটে একাউন্ট খুলে দিতেন। তিনি প্রতিটি একাউন্ট খোলার জন্য পেতেন ৩০০ টাকা কমিশন।
অনলাইন জুয়ার অর্থ লেনদেন করতো সুমন
গ্রেফতার সুমন অনলাইন জুয়ার অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিল। তিনি রাজধানীর মালিবাগে স্টেশনারি ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা করতেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসার সুবাদে গ্রেফতার কামরুলের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে কামরুল তাকে কম সময়ে বেশি অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন বেটিং সাইটের অ্যাকাউন্ট খুলে দেয় এবং তার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ার সব টাকা লেনদেনে উদ্বুদ্ধ করে।
সুমন পরিচয় গোপন করে অনলাইন জুয়ার আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য কৌশলে তার পাশের একজন মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসায়ীর নামে নিবন্ধনকৃত সিম সংগ্রহ করে, যাতে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট হিসেবে লেনদেন করা যেত। পরে তিনি বিভিন্ন অনলাইন বেটিং সাইটের সবধরনের লেনদেন ওই মোবাইল সিম দ্বারা নিবন্ধনকৃত মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সম্পন্ন করতেন। এ ছাড়াও তিনি নামে-বেনামে বিভিন্ন সিম সংগ্রহ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার অর্থ লেনদেন করতেন। গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ তিনি গ্রেফতার নিশাত মুন্না ও কামরুলের সহায়তায় হুন্ডির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশে অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম পরিচালনাকারীর কাছে পাঠাতেন।
ব্যবসার পাশাপাশি অনলাইন জুয়ায় জড়ায় নাজমুল
গ্রেফতার নাজমুল নোয়াখালীতে থাই গ্লাসের ব্যবসা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত। এক বছর আগে গ্রেফতার কামরুলের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার আর্থিক লেনদেনে জড়ান তিনি। তিনি নোয়াখালী অঞ্চলে বেটিং সাইটের জন্য গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় অর্থ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করতেন এবং বেটিং সাইটে টাকা রিচার্জ ও বেটিং সাইট থেকে টাকা উত্তোলনের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম