Tuesday 12 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শীত আসার আগেই নিঃশ্বাসে ‘বিষ’

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৪ নভেম্বর ২০২৩ ২১:৪৮

বায়ুদূষণে নাকাল ঢাকাসহ সারাদেশ। ফাইল ছবি

ঢাকা: বাতাসে শীতের আগমনী বার্তা। শীত না থাকলেও হাজির শুষ্কতা আর সেই সঙ্গে চিরাচরিত বায়ুদূষণ। প্রতিবছরই সরকার এই বায়ুদূষণ কমাতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার দাবি করলেও তা কাজে আসছে না। উলটো বছর বছর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু মুখে বলে নয়, কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া গেলে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিরস্বরূপ এই দূষণ কমানো সম্ভব না।

বায়ুদূষণ পরিমাপের নানা সূচক বলছে, অক্টোবর মাস থেকেই ঢাকার বায়ু অতিমাত্রায় দূষিত। চলতি বছর বর্ষাকালেও কমেনি এই দূষণ। বৃষ্টিপাত কম হওয়াসহ নানা কারণকে এই দূষণের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের জন্য দায়ী মনে করা হয়। তবে বাকি ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ দূষণ নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর উদ্যোগ নেই বলেই অভিযোগ পরিবেশ অধিকার কর্মীদের।

বিজ্ঞাপন

এ পরিস্থিতিতে শীত আসার আগেই শুরু হয়েছে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব। সরাসরি ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে যেমন ভুগছে মানুষ, সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে ধুলাবাহিত রোগজীবাণু। পরিবেশসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দূষণ কমানোর পাশাপাশি জনগণকে আবহাওয়ার মতো প্রতিদিন দূষণ পরিস্থিতিও জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈশ্বিক বায়ুমান পরিমাপক সংস্থা আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর থেকেই ঢাকার বায়ুমান মারাত্মক খারাপ। এর আগে বর্ষা ও শরৎকালেও ঢাকার বায়ু এমনকি মধ্যম মানেরও ছিল না। ওই সময়েই বিশেষজ্ঞরা রাস্তা থেকে ধুলা-কাদা সরানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে সে পরামর্শ মানা হয়নি। ফলে বায়ুমানেরও উন্নতি হয়নি।

ঢাকা শহর ঘুরে দেখা যায়, রাতে রাজধানীতে ট্রাকসহ অন্যান্য মালবাহী বড় যানবাহন চলে। সেইসঙ্গে চলে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ওঠানোর কাজ। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্লাস্টিক ও অন্যান্য কঠিন বর্জ্য তুলতে দেখা গেলেও রাস্তা থেকে ধুলা সরাতে দেখা যায় না। ফলে ঝাড়ু দিলে এসব ধুলা উড়তে থাকে। এ ছাড়া সকালে রাজধানীর কিছু এলাকায় সিটি করপোরেশন থেকে পানি ছিটালেও অধিকাংশ এলাকায় বিশেষ করে অলিগলিতে পানি ছিটানো হয় না।

বিজ্ঞাপন

এ ছাড়া রাজধানিজুড়ে চলমান সরকারি-বেসরকারি নির্মাণকাজের ক্ষেত্রেও ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো, বালুর ট্রাক ঢেকে চলাচল করার মতো বিষয়গুলো মেনে চলা হয় না বললেই চলে। এসব কারণের সঙ্গে রাজধানীতে চলমান ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ধোঁয়া, আশপাশের ইটইভাটার কারণেও এ সময় দূষণ বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন-

এদিকে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আট বছরের মধ্যে গত তিন বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে সবেচেয়ে বেশি দূষণের শিকার ঢাকা। ২০২১ সালের গড় বায়ুমান সূচক ১৫৯ দশমিক শূন্য ৮, ২০২২ সালের গড় বায়ুমান সূচক ১৬২ দশমিক ৮৪ এবং ২০২৩ সালের ১০ মাসের গড় বায়ুমান সূচক ছিল ১৬৫।

আমেরিকান দূতাবাস থেকে পাওয়া বায়ুদূষণের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে ক্যাপস দেখেছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত (২০২২ ছাড়া) প্রতিবছরই জানুয়ারি মাসে গড় বায়ুমান সূচক ছিল সর্বোচ্চ ২৪৮ দশমিক ২৪ একিউআই। আর সর্বনিম্ন মানগুলো পাওয়া যায় জুলাইয়ে ৮৯ ও আগস্টে ৯৮ একিউআই। আর নভেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ১৭৪ দশমিক ৫২ একিউআই।

এ ছাড়াও চলতি বছরের অক্টোবর মাসের বায়ুদূষণের মাত্রা আগের ছয় বছরের অক্টোবর মাসের তুলনায় ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি ছিল। আর গত বছরের তুলনায় এ বছর বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে ১৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত।

এদিকে গত সাত বছরের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে ঢাকায় অক্টোবর মাসের বায়ুমান সূচক গড়ে ছিল ১৩২ দশমিক ৫ একিউআই, ২০১৭ সালে ১১৫ একিউআই, ২০১৯ সালে ১৩১ একিউআই, ২০২০ সালে ১২৮ একিউআই ও ২০২১ সালে ছিল ১৫২ একিউআই। ২০২২ সালের বায়ুমান সূচক ২০২১ সালের তুলনায় কমে গড়ে ১৩১ দশমিক ৭ একিউআইতে এসে দাঁড়িয়েছিল। এ বছর সেই মান দাঁড়িয়েছে ১৫৩ দশমিক ২৬ একিউআইতে, যা সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

একিউএয়ারের তথ্য আরও বলছে, চলতি বছর অক্টোবর মাসে ঢাকার বায়ুমান একদিনও ভালো (০-৫০ একিউআই) ছিল না, মধ্যম (৫১-১০০ একিউআই) ছিল ছয় দিন, সতর্কতা মানে (১০১-১৫০ একিউআই) ছিল চার দিন। বাকি ২১ দিনের মধ্যে ২০ দিনই ছিল অস্বাস্থ্যকর (১৫১-২০০ একিউআই), একদিন ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর (২০১-৩০০ একিউআই)।

ঢাকায় বায়ুদূষণের এমন চিত্র নিয়মিত। ফাইল ছবি

এ ছাড়া চলতি বছরের ১০ মাসের মধ্যে পাঁচ মাসেই গড় ‍দূষণের মাত্রা ছিল গত সাত বছরের সংশ্লিষ্ট মাসগুলোর চেয়ে বেশি। কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এতদিন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে দূষণ হলেও এখন ধরন বদলেছে। ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ায় সেখানে গাড়ি উঠতে গিয়ে বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। কারণ সাধারণ গাড়িগুলো উঁচু জায়গায় আরোহণের জন্য উপযুক্ত না হলেও ওপরে উঠতে হচ্ছে তাদের, যা ধোঁয়ার দূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। একইসঙ্গে সড়কের ধুলাবালিও গাড়ির সঙ্গে ওপরের দিকে উঠছে, যা দূষণের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা লেনিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, এই মুহূর্তে আবহাওয়া যখন শুষ্ক হতে শুরু করেছে তখন আমাদের দেশ এবং সমগ্র উপমহাদেশেই বায়ুদূষণ ক্রমাগত বাড়ছে। এতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ দুই ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দেয়। প্রত্যক্ষ সমস্যার মধ্যে সবার আগে দেখা যায় শ্বসনতন্ত্রের সমস্যা। হাঁচি, কাশি, শ্বাসের টান বেড়ে যায়। আগে থেকে যারা অ্যাজমা আক্রান্ত, তাদের সমস্যা বেড়ে যায়। শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া বেড়ে যায়।

জাতিসংঘের একটি সংস্থার জরিপের তথ্য থেকে ডা. লেনিন বলেন, বিশ্বের যত মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, তার চার ভাগের এক ভাগ বায়ু দূষণজনিত কারণে মারা যায়। এ ছাড়া এ সময়ে আবহাওয়া শুষ্ক হওয়ার কারণে চর্মরোগ আর অ্যালার্জির সমস্যাও বেড়ে যায়। অন্যদিকে পরোক্ষ সমস্যার মধ্যে রয়েছে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা ও ময়লার মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমণ। এসব ধূলিকণা খোলা খাবারে পড়লে সেই খাবার খেয়ে বমি, পাতলা পায়খানা, আমাশয়, টাইফয়েডের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

বায়ুদূষণ কমাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে— জানতে চাইলে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, বায়ুদূষণের মূল কারণ আমরা জানি, জানি উৎস। সেই উৎসকে দূর করার জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা নেওয়া হচ্ছে না। সর্বশেষ হাইকোর্ট দুই দফায় ১৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করলে অন্তত স্বল্পমেয়াদি দূষণ রোধ করা যায়। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের জন্য পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা নিতে হবে।

বায়ু দূষণ। ফাইল ছবি

ডা. লেনিনসহ পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যেসব পরামর্শ দিচ্ছেন তার মধ্যে রয়েছে— ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী মোটরবাহনের ফিটনেস ও এগুলোতে মানসম্মত জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে; ঢাকায় জনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোনো ধরনের কলকারখানা বা কেমিক্যাল কারখানা রাখা যাবে না; ঢাকার চারপাশে থাকা ইটভাটাকে মানসম্মত করতে হবে এবং অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে হবে; পূর্ণাঙ্গ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে; শীতকালে যেখানে সেখানে আগুন জ্বালানো বন্ধ করতে হবে; মেগা প্রকল্প থেকে শুরু করে সবধরনের অবকাঠামো নির্মাণের সময় পরিবেশের সুরক্ষার মানদণ্ড মেনে চলতে হবে।

এ ছাড়া নিয়মিত প্রক্রিয়া হিসেবে জনসাধারণকে দূষিত বায়ু থেকে রক্ষার জন্য দিনের শুরুতেই ওই দিনের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি জানানোর প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বলছেন, কোন কোন দিনে সংবেদনশীল মানুষ, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য বাইরে বের হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ এবং বাইরে গেলেও কখন বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হবে, এগুলো আগেই সবাইকে জানাতে হবে।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, আমাদের দেশের বায়ুদূষণের জন্য ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ দায় পাশের দেশের। বাকি ৬৫ শতাংশের জন্য দায়ী ইটভাটা, যানবাহন, নির্মাণকাজ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটি ইত্যাদি। এগুলো নিরসনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এ বছর বর্ষা প্রায় দুই মাস দেরি করে আসায় শুষ্কতাও দুই মাস বেশি ছিল যার ফলে দূষণও বেশি ছিল।

শীতে মারাত্মক বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদফতরের গাফিলতি নেই দাবি করে জিয়াউল হক বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। আরও ম্যাজিস্ট্রেট পেলে কাজটি নিয়মিত করা যাবে। এ ছাড়া গত বছর থেকেই আমরা নির্মণকাজের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। অর্থাৎ ঢেকে রেখে কাজ করা, পানি ছিটানো— এগুলোর ব্যত্যয় হচ্ছে কি না, দেখছি। এ বছরও অভিযান চলবে, জরিমানা করা হবে। আর যানবাহনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমরা বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং করছি।

তবে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ একা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্ভব না বলেই এটি নিরসনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানান পরিবেশ অধিদফতরের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সচিব, অধিদফতরের পরিচালক ও চেয়ারম্যানদের নিয়ে একটি কমিটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। একটি বৈঠক হয়েছে। ১৯ নভেম্বর আরেকটি বৈঠক আছে। আমরা আশাবাদী, সবাই মিলে কাজ করে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

অস্বাস্থ্যকর বায়ু পরিবেশ দূষণ বায়ুদূষণ বায়ুমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর