দলগুলোকে সমাধান খুঁজতে ও জনগণকে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান
১৫ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৫২
ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংঘাত এড়িয়ে সংকটের সমাধান সন্ধানের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। পাশাপাশি ভোটারদের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
বুধবার (১৫ নভেম্বর) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সিইসি এ আহ্বান জানান। ভাষণে তিনি ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে সিইসি বলেন, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য কাঙ্ক্ষিত অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে, বিশেষত নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রশ্নে, দীর্ঘসময় ধরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ দেখা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন- ৭ জানুয়ারি ভোট
বহুদলীয় রাজনীতিতে মতাদর্শগত বিভাজন থাকতে পারে উল্লেখ করে সিইসি এই বিভাজন যে সহিংসতায় রূপ না নেয়, সেই আহ্বান জানান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি।
তিনি বলেন, মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। মতৈক্য ও সমাধান প্রয়োজন। আমি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করে সদয় হয়ে সমাধান অন্বেষণ করতে। জনগণকে অনুরোধ করব সব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি পরাভূত করে নির্ভয়ে আনন্দমুখর পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে এসে অবাধে মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে।
আস্থা ও সহনশীলতার ডাক দিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সবসময় স্বাগত জানাবে। পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়। পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক আস্থা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা টেকসই ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যকীয় নিয়ামক।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভাষণের শুরুতে সিইসি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান দেশের আপামর জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি। সংবিধানে জনগণকেই ক্ষমতার মালিক ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জনগণের সেই মালিকানা প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হচ্ছে অবাধ ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন।
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ২০ মাসে ১৬টি উপনির্বাচনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের হাজারেরও বেশি নির্বাচন আয়োজন করেছেন বলে ভাষণে উল্লেখ করেন সিইসি। আগ্রহী সব রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী সমাজ, শিক্ষাবিদ, নাগরিক সমাজ, সিনিয়র সাংবাদিক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে একাধিকবার সংলাপ ও মতবিনিময়ের কথাও উল্লেখ করেন। বলেন, তাদের মতামত শুনেছি। সুপারিশ জেনেছি। আমাদের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেছি। নিবন্ধিত অনাগ্রহী রাজনৈতিক দলকেও একাধিকবার আমন্ত্রণ জানিয়েছি, তারা আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন উল্লেখ করে সিইসি ভাষণে বলেন, সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্বলিত এই নির্দেশনা নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে আয়োজন করে থাকে। সরকার আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সুষ্পষ্ট প্রতিশ্রুতি বারংবার ব্যক্ত করেছে। কমিশনও তার আয়ত্তে থাকা সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে এবং সরকার থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করার বিষয়ে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলকে আচরণ বিধিমালা প্রতিপালন করতে হবে জানিয়ে সিইসি বলেন, নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত সব কর্মকর্তাকেও আইন ও বিধিবিধান যথাযথভাবে পালন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। জাল ভোট, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, অর্থের লেনদেন ও পেশীশক্তির সম্ভাব্য ব্যবহার নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেকোনো মূল্যে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করতে হবে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল এ পর্যায়ে নির্বাচনের ভোটার ও ভোটকেন্দ্রের কিছু তথ্য উল্লেখ করে নির্বাচন সম্পর্কিত সব তারিখ তথা তফসিল ঘোষণা করেন। নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিল এবং সবার জন্য ভোট সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের জন্য দুটি ডিজিটাল অ্যাপ চালুর তথ্য তুলে ধরেন। ভোটের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন। বলেন, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় কমিশনের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে। অন্যদিকে অসত্য, মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সম্প্রচার করে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া ও নির্বাচনকে প্রভাবিক করার যেকোনো অপপ্রয়াস প্রতিহত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।
ভোটারদের উৎসবমুখর পরিবেশে উৎসাহ-উদ্দীপনা, সাহজ ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নির্বিঘ্নে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানিয়ে সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, আপনাদের মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করে পছন্দের প্রার্থকে নির্বাচিত করে সংসদ ও সরকার গঠনে নাগরিক দায়িত্ব পালন করবেন। ভোট আপনার। ভোটদানে কারও হস্তক্ষেপ বা প্ররোচনায় প্রভাবিত হবেন না। কোনো হস্তক্ষেপ বা বাধার মুখে পড়লে একক বা সামষ্টিকভাবে তা প্রতিগত করবেন। প্রয়োজনে অবিলম্বে কেন্দ্রে প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন। প্রিজাইজিং কর্মকর্তা যেকোনো মূল্যে যেকোনো অপচেষ্টা প্রতিহত করে ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আইনত দায়িত্বপ্রাপ্ত ও বাধ্য।
ভোটের প্রার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সিইসি বলেন, কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সাহসী, সৎ, দক্ষ ও অনুগত পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করে প্রার্থী হিসেবে আপনার নিজ নিজ অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা কার্যত আপনাদেরই করতে হবে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এটি একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
সবার সহযোগিতায় সুন্দর নির্বাচনের আশাবাদ জানিয়ে সিইসি বলেন, নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত সব কর্মকর্তা সৎ, নিরপেক্ষ ও অবিচল থেকে আইন ও বিধি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবেন। আমাদের বিশ্বাস, নিজ নিজ অবস্থান থেকে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল আচরণ ও আবশ্যক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ হবে। দেশে ও বহির্বিশ্বে নির্বাচন প্রশংসিত ও বিশ্বাসযোগ্য হবে। দেশের জনশাসনে জনগণের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র সুসংহত হবে।
নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ আপামর জনগণের আন্তরিক অংশগ্রহণ ও সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করে এবং নির্বাচন সফল ও ফলপ্রসূ হওয়ার আশাবাদ জানিয়ে ভাষণ শেষ করেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।
আরও পড়ুন-
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
কাজী হাবিবুল আউয়াল জাতির উদ্দেশে ভাষণ জাতীয়-নির্বাচন তফসিল ঘোষণা নির্বাচনি তফসিল সিইসি