আ.লীগে বর্তমান-সাবেক এমপির লড়াই, বিএনপি প্রথমের সন্ধানে
২৫ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:০২
খুলনা: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ‘সুন্দরবন’ তার একাংশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে যে জেলাটিকে সেটি খুলনা। সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, কবি কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদারের মতো অসংখ্যা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জন্মভূমি এই খুলনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রতন সেন, বিশিষ্ট পানি বিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাতসহ অসংখ্য গুণীব্যক্তির পূণ্যভূমিও এটি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাউদ্দিন ইউসুফ, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, খলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার আবদুর রাজ্জাকসহ অসংখ্য রাজনীতিক এই খুলনায় জন্ম নিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত খুলনার রাজনীতি বেশ চাঙ্গা ছিল। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্তও সেই চাঙ্গাভাবের রেষ থাকে। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতি ঝিমিয়ে পড়ে। মাঝে একবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কিছুটা চাঙ্গা হয়েছিল খুলনার রাজনীতি। তবে গোটা খুলনায় এখন রাজনীতির কোনো চমক নেই, জৌলুসও নেই। মাঝখানে তো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে পড়েছিল। তবে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে রাজনীতি ফের চাঙ্গা হয়েছে।
আসছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরই মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অবশ্য সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা এখনো হরতাল-অবরোধ দিয়ে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে।
বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই খুলনার সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি রয়েছে আন্দোলনে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও দুয়েকটি আসন দখলে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে খুলনা-৬ আসনের চিত্র।
খুলনা নিজেই উপকূলীয় জেলা। এই জেলারই উপকূলবর্তী দুই উপজেলা কয়রা ও পাইকগাছা নিয়ে গঠিত খুলনা-৬ সংসদীয় আসনটি। সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা জাতীয় সংসদের ১০৪ নম্বর এই আসনটিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্যসঙ্গী। মজবুত ও টেকসই বেড়িবাঁধের আশ্বাস থাকলেও গত দুই দশকে এ আসনের মানুষ প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার ক্ষত বয়ে বেড়ানো এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের বসবাস দারিদ্র্যসীমার নিচে।
আরও পড়ুন-
- ‘ঘাঁটি’ ধরে রাখতে চায় আ. লীগ, বিএনপি-জামায়াতে দ্বন্দ্ব
- সালাম মূর্শেদীর সামনে সুকর্ণসহ ৮, বিএনপির শুধুই হেলাল
- আওয়ামী লীগে মন্নুজান-কামাল দ্বৈরথ, বিএনপি খুঁজছে নতুন মুখ
- আ.লীগে একক প্রার্থী শেখ জুয়েল, বিএনপি ফেরাতে পারে মঞ্জুকে
- আ.লীগে পঞ্চানন-ননী দ্বৈরথ, বিএনপি-জাপায় এজাজ ও সুনীল এগিয়ে
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গোটা এলাকা ছেয়ে গেছে ব্যানার-ফেস্টুনে। প্রার্থীদের আনাগোনা আর তৎপরতা এলাকায় এনে দিয়েছে নির্বাচনি আমেজ। আসনটিতে শক্ত অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে হাইকমান্ডের নির্দেশ পেলে ঘুরে দাঁড়াতে চায় বিএনপিসহ অন্য দলগুলোও।
এই আসনে আশির দশকের দুই নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন জাতীয় পার্টির দুই প্রার্থী মোমেন উদ্দিন আহমেদ ও জহুরুল হক সরদার। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর শাহ মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস। এর বাইরে ১৯৯৬ সালের ১৬ জুনের নির্বাচনসহ পরের বাকি নির্বাচনগুলোতে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
উপকূলীয় এই আসনে আওয়ামী লীগের শেখ মো. নূরুল হক নির্বাচিত হন ১৯৯৬ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন সোহরাব আলী সানা। আর ২০১৮ সালে নৌকা নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আক্তারুজ্জামান বাবু।
দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে খুলনা-৬ আসনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন মোট ১৫ জন। তাদের মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু রয়েছেন। রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য সোহরাব আলী সানাও।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারীদের মধ্যে আরও রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুজ্জামান জামাল, সাংগঠনিক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার প্রেম কুমার মন্ডল, শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক শেখ রাশেদুল ইসলাম রাসেল, কয়রা আওয়ামী লীগ সভাপতি জি এম মহসিন রেজা, উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মনিরুল ইসলাম, পাইকগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইকবাল মন্টু, জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কোষাধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার জি এম মাহবুবুল আলম, পাইকগাছা উপজেলার সাবেক সভাপতি মো রাশিদুজ্জামান মোড়ল, জেলা নেতা মো. খাইরুল আলম, এস এম সাইফুল্লাহ আল মামুন ও যুবলীগ নেতা এস এম রাজু।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বর্তমান সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু এবং সাবেক সংসদ সদস্য সোহরাব আলী সানা এই আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রয়েছেন। এবারে নৌকার প্রার্থী হিসেব এগিয়ে রয়েছেন এই দুজনই। তরুণদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার প্রেম কুমার মন্ডল এবং ইঞ্জিনিয়ার জি এম মাহবুবুল আলমের সম্ভাবনাও দেখছেন কেউ কেউ।
এই আসন থেকে কখনো জয়লাভ করতে পারেনি বিএনপি। দুবার জোটের প্রার্থী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী জয় পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে এবারে বিএনপি নির্বাচনে গেলে এই আসনে প্রথমবারের মতো জয়ের সন্ধানে মরিয়া থাকবে। এই আসনে দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছেন নগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এস এম শফিকুল আলম মনা। এ ছাড়া জেলা ছাত্রদল ও যুবদলের সাবেক সভাপতি মনিরুজ্জামান মন্টু, বিএনপি নেতা শেখ শামসুল আলম পিন্টু, কয়রা উপজেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট মোমরেজুল ইসলামও রয়েছেন আলোচনায়।
এদিকে, জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি শফিকুল ইসলাম মধু এ আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। আবার দুই নির্বাচনে জয় পাওয়া জামায়াতও এই আসনে প্রার্থী দিতে চায়। তাদের প্রার্থী হতে পারেন সাবেক মহানগর আমির আবুল কালাম আজাদ। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হতে পারেন এই আসনে আসাদুল্লাহ আল গালীব।
জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক শেখ রাশেদুল ইসলাম রাসেল বলেন, আওয়ামী লীগ মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বৃহৎ রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার অধিকার দলের প্রতিটি সদস্যের রয়েছে। দলীয় নেতৃত্ব যাকেই মনোনয়ন দেবে সবাই তার পক্ষে কাজ করবে।
খুলনা-৬ আসনের বর্তমান সংসদ আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, এ আসনে আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর গত কয়েক বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সাধারণ মানুষেরও আমার প্রতি আগ্রহ আছে। ব্যাপক জনসমর্থনও পাচ্ছি। আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করে যেতে চাই।
নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলতে খুলনা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও নাম্বারটি বন্ধ থাকায় মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, খুলনা-৬ আসনে মোট ভোটার চার লাখ পাঁচ হাজার ৩১৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ ৪০ হাজার ৪৯ জন, নারী ভোটার দুই লাখ ১২ হাজার ৬৭ জন।
সারাবাংলা/টিআর
আক্তারুজ্জামান বাবু এস এম শফিকুল আলম মনা খুলনা-৬ খুলনা-৬ আসন জাতীয়-নির্বাচন জি এম মাহবুবুল আলম দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন প্রেম কুমার মন্ডল সংসদ নির্বাচন সোহরাব আলী সানা