Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমন মৌসুমে বেসামাল চালের বাজার

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৭ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:০২

আমনের মৌসুমেও হঠাৎ বেসামাল হয়ে উঠেছে রাজশাহীর চালের বাজার। ছবি: সারাবাংলা

রাজশাহী: সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও চালের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। বরং আমন মৌসুমে হু হু করে বাড়ছে দাম। এক মাসের ব্যবধানে ৫০ কেজির বস্তায় চালের দাম বেড়েছে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।

পাইকারি চাল বিক্রেতারা বলছেন, মিলার ও মৌসুমি ধান ব্যবসায়ীদের কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর এই বাড়তি দর পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা সমন্বয় করছেন। ফলে চাল কিনতে বেশি টাকা খরচ হওয়ায় ক্রেতারা পড়ছেন বেকায়দায়।

বিজ্ঞাপন

মিল মালিকরা বলছেন, মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা আঠাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ২৯০০ থেকে ৩০০০ টাকায়, যা এক সপ্তাহখানেক আগেও ২৬০০ থেকে ২৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মোটা চাল (গুটি স্বর্ণা) প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৩৫০ থেকে ২৪০০ টাকায়, যা সপ্তাহখানেক আগে ২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে জিরাশাইল চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৩২০০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ২৮০০ টাকায়।

এই চাল আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে গেলে বস্তায় আবার দাম বেড়ে যাচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে গিয়ে আরও এক দফা দাম বাড়লে মিল থেকে ক্রেতার কাছে যেতে যেতে প্রকারভেদে বস্তায় ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে যাচ্ছে চালের।

চালের দামের এমন বেসামাল দশা হলেও চাল ব্যবসায়ীরা দুষছেন একে অন্যকে। পাইকারি চাল বিক্রেতারা বলছেন, মিল মালিকরা দাম বাড়াচ্ছে। মিল মালিকরা বলছেন, মৌসুমী ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছে। এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষ দিচ্ছেন পাইকারদের।

আরও পড়ুন- ভোটের পরেই হঠাৎ অস্থির চালের বাজার

চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, কখনো সরবরাহ সংকট, আবার কখনো ধানের দাম বেশি বলে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। আমনের ভরা মৌসুমে সংকটের কথা বলে আবারও চালের দাম বস্তায় সর্বোচ্চ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বেশি দামে কিনে পাইকারিতেও বেশি টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

তারা আরও বলছেন, যে চালের বস্তা এক মাস আগে ২৮০০ টাকায় বিক্রি করতেন, তা এখন ৩২০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। পাশাপাশি বিআর-২৮ চাল পাইকারিতেই ২২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪০০/২৪৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এর প্রভাবেই দাম বেড়েছে খুচরা বাজারে।

আমনের মৌসুমে চালের বাজার কেন বেসামাল, তার কারণ খুঁজতে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বাজারে টিম পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। বুধবার সকালে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভরা আমন মৌসুমে কেন এত দাম বেড়েছে, সেটা আমাদেরও প্রশ্ন। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিতে আমরা অফিসারদের পাঠিয়েছে। গতকালও (মঙ্গলবার) পাঠিয়েছিল, আজও (বুধবার) তারা বাজারে গেছে। দেখি কারণটা কী। এরপর আপনাদের বিস্তারিত জানাব।’

রাজশাহীতে দৈনিক বাজারে পণ্যের মূল্য তালিকায় দেখা গেছে, খুচরা বাজারে একজন ক্রেতাকে প্রতিকেজি চাল (মোটা জাতের) কিনতে ৫০ টাকা গুনতে হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি মোটা চালের দাম তিন থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে। মাঝারি আকারের প্রতিকেজি চালের দাম বেড়েছে সপ্তাহের ব্যবধানে পাঁচ থেকে আট টাকা।

নগরীর সাহেববাজারে চাল কিনতে গিয়েছিলেন রিকশাচালক শামসুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ভোটের পর থেকে চালের দাম আবার বেড়েছে। আমরা দিন আনি দিন খাই। প্রতিদিন আমাদের চাল কিনে খেতে হয়। মোটা চাল ভোটের আগে কিনেছি ৪৫ টাকায়। ভোটের পর সেই চালের দাম বেড়ে হয়ে গেল ৫২ টাকা। এভাবে দাম বাড়লে তো আমাদের জন্য সমস্যা।’

নগরীর সাহেববাজারের এপি চাউল ভাণ্ডাারের স্বত্বাধিকারী প্রকাশ প্রসাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সরাসরি মিল থেকে চাল নিয়ে আসছি। মিল থেকেই বাড়তি দামে বিক্রি করছে। সেজন্য আমাদের দাম বাড়াতে হচ্ছে। মিল মালিকরা যদি কম রাখে তাহলে আমরাও কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য।’

অন্যদিকে নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার পাইকারি চাল বিক্রেতা ফাতেমা রাইস এজেন্সির মালিক দাবিরুল ইসলাম বলেন, ‘গত এক সপ্তাহ ধরে বেড়ে চলেছে চালের দাম। প্রতিদিনই বাড়ছে। এ জন্য আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আশা করি চালের দাম কমলেও আমরাও কম দামে চাল বিক্রি করতে পারব।’

কামাল অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী কামাল হোসেন বলেন, ‘এখন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা ধান মজুত করে রেখেছেন। তারা বাড়তি দাম না পেলে ধান ছাড়ছে না। ফলে তাদের কাছে বেশি দামে ধান কিনে নিয়ে আসতে হচ্ছে। আমাদের খরচও আছে। এ কারণে দাম বাড়ছে।’

রাজশাহী চালকল মালিক সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলামও ধানের দামকেই দায়ী করছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘চালের দাম বাড়লেই আমাদের দোষ হয়। কিন্তু এখন ধানের দাম বাড়তি থাকায় চাল প্রক্রিয়াজাতকরণে বেশি খরচ হচ্ছে। এ কারণে মিল পর্যায় থেকে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। কৃষকদের পাশাপাশি ধানের মৌসুমি ব্যবসায়ী এখন ধান মজুত করছে। দাম বেশি না হলে তারা বাজারে ছাড়ছেন না। এ কারণে বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে।’

চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা দেখছেন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) রাজশাহী জেলা সভাপতি কাজী গিয়াস। তিনি বলেন, ‘সবার ধারণা থাকে, আমন মৌসুমে দাম স্বাভাবিক হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে চাল। তাই ক্রেতা তথা নিম্ন আয়ের মানুষকে আরও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। মুনাফাখোররা কারসাজি করে চালের বাজারে সংকট তৈরির চেষ্টা করছে। সরকারের এদিকে নজর দেওয়া উচিত। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সরকারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে। তদারকি জোরদার করতে হবে। অনিয়ম পেলে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’

জেলা বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা আফরিন হোসেন বলেন, ‘বেশ কিছুদিন থেকে চালের দাম বাড়ছে। এরই মধ্যে আমরা বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছি। দুয়েক দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের রাজশাহীর উপপরিচালক ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের অভিযান চলছে। চাল ব্যবসায়ীদের সতর্কও করা হচ্ছে। এরপরও যারা সতর্ক হচ্ছে না তাদের জরিমানা করা হচ্ছে।’

ধান-চালের বাজারের এমন বেসামাল অবস্থার মধ্যেই সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানিয়েছে, দুয়েক দিনের মধ্যেই তারা পণ্য বিক্রি করতে শুরু করবে। রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি এসেছে। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেলে দুয়েক দিনের মধ্যেই টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু করতে পারব। এবারও আমরা পাঁচ কেজি চাল, দুই কেজি মসুর ডাল ও দুই লিটার তেল বিতরণ করব। চাল প্রতিকেজি আমাদের এখানে দাম পড়ে ৩০ টাকা।’

চালের বাজারে অস্থিরতার মধ্যে টিসিবি ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি শুরু করলে তা নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সারাবাংলা/জেআর/টিআর

চালের দাম চালের বাজার ধানের দাম ধানের বাজার রাজশাহী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর