Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুন্দরবনকে ভালোবাসুন

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৫০

খুলনা: সুন্দরবন দিবস আজ। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০১ সাল থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বা লবণাক্ত পানির বন সুন্দরবন। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ সুন্দরবন সন্নিহিত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দিবসটি পালন করা হবে। প্রতি বছর দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানটি দেখতে আসেন।

বিজ্ঞাপন

কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সুন্দরবন দিবসে সকাল ১১টায় খুলনা প্রেসক্লাবের হুমায়ুন কবীর বালু মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। খুলনা প্রেস ক্লাব ও সুন্দরবন একাডেমির যৌথ উদ্যোগে এবারে খুলনায় কেন্দ্রীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালন করা হচ্ছে। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘প্লাস্টিক ও পলিথিনমুক্ত সুন্দরবনের জনপদ’।

এছাড়া বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনায় এবং উপজেলা পর্যায়ে দাকোপ, আশাশুনি, শ্যামনগর, মোংলা, শরণখোলায় দিবসটি পালন করা হবে। ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন (টোয়াস) আগামীকাল খুলনা মহানগরীর লায়ন্স স্কুল মিলনায়তনে সুন্দরবন বিষয়ক চিত্রাঙ্কন এবং রচনা প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী এবং খুলনা সাইক্লিং কমিউনিটি এ উপলক্ষে এক বর্ণাঢ্য সাইকেল র‌্যালির আয়োজন করেছে।

সুন্দরবনের প্রাণী বৈচিত্রের মূল আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনে গেলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা সবসময় না পাওয়া গেলেও এর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নীরবতা ও জীববৈচিত্র্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এছাড়া পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির, বানর ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল সুন্দরবন। এছাড়া, দেখতে পাওয়া যায় হরিণ, বানর, বন্য শুকর, বন বেড়াল, ডলফিন, বিভিন্ন পাখি।

এই বনভূমিতে বিখ্যাত সুন্দরী ও গোলপাতা গাছও পাওয়া যায়। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে রয়েছে ৫ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৯৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৭৯ প্রজাতির পাখি, ১২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ৩০ প্রজাতির চিংড়ি মাছ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সুন্দরবনে ঘুরবেন যেখানে

সুন্দরবনের করমজল ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র, হারবারিয়া, কোকিলমনি, কটকা, হিরন পয়েন্ট জামতলা সৈকত, মান্দারবাড়িয়া সৈকত, কটকা বিচ, দুবলার চর ও বঙ্গবন্ধুর চর ও সুন্দরবনের বাঘের বাড়ি খ্যাত শেখেরটেক ইকোটুরিজম কেন্দ্র। সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো সময় শীতকাল। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সময়কালটি বন ও প্রকৃতি শান্ত থাকে।

সুন্দরবনে বেড়েছে হরিণের সংখ্যা

২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জার্মানির কেএফডব্লিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সার্বিক সহযোগিতায় সুন্দরবনে হরিণসহ ৫টি প্রাণীর সংখ্যার উপর জরিপ চালানো হয়েছে। এ জরিপে দেখা গেছে বর্তমানে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালে হরিণের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজারটি। সেই হিসেবে ১৯ বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে হরিণের বেড়েছে ৫৩ হাজার ৬০৪টি।

র‍্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও বন বিভাগের নিয়মিত টহলের কারণে হরিণ শিকারের সুযোগ কমে গেছে। সুন্দরবনে রাসমেলা বন্ধ হয়ে যাওয়া ও সুন্দরবন জলদস্যু মুক্ত হওয়ায় হরিণ শিকার কমেছে। এছাড়া সুন্দরবনে অভয়ারণ্য বৃদ্ধি ও আবাসস্থলের উন্নয়ন ঘটায় বন্যপ্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সে কারণেও হরিণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন বন কর্মকর্তারা।

সুন্দরবনে নির্মিত হচ্ছে বাঘের টিলা

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়াতে সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় চাঁদপাই, শরণখোলা, খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের প্রতিটিতে ৩টি করে মোট ১২টি কৃত্রিম টিলা তৈরি করছে বন কর্তৃপক্ষ। ২০২২ সালের ২৩ মার্চ সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এর ব্যয় ধরা হয় আনুমানিক ৩৬ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ, তাদের খাবার হিসেবে বিবেচিত প্রাণী ও খাল জরিপ করার মতো আরও কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

হুমকির মুখে মৎস্য সম্পদ

সুন্দরবনে স্থানীয় অসাধু কিছু জেলে নামধারী মৎস্য দস্যু বিষ দিয়ে মাছ ধরছে। বেশি মুনাফার আশায় সুন্দরবনের বিভিন্ন নিষিদ্ধ খালেও বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়া এই বনের নদ-নদী ও খালে ভেটকি, রূপচাঁদা, দাঁতিনা, চিত্রা, পাঙাশ, লইট্যা, ছুরি, মেদ, পাইস্যা, পোয়া, তপসে, লাক্ষা, কই, মাগুর, কাইন, ইলিশসহ ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ হয়ে থাকে। এছাড়া রয়েছে গলদা, বাগদা, চাকা, চালী, চামীসহ ২৪ প্রজাতির চিংড়ি। সুন্দরবনের গরিব জেলেদের দাদনের ফাঁদে ফেলে বিষ দিয়ে মাছ শিকারে উৎসাহিত করে কিছু অসাধু মানুষ। গত দুই বছরে প্রশাসনের অভিযানে ২৯৩টি নৌকা ও সুন্দরবন থেকে বিষ দিয়ে ধরা ৩ হাজার ৬৬০ কেজি মাছ জব্দ করা হয়েছে। ২১৬টি মামলা ও ২২৪ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে। বনের ভিতর আইনশৃঙ্খলা রক্ষঅকারী বাহিনীর নিয়মিত টহলের কারণে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করার সুযোগ অনেকটায় কমেছে।

পদ্মা সেতুর কারণে বেড়েছে পর্যটক

সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য হাতছানি দেয় দেশি-বিদেশি নানা রঙের মানুষকে। বিশ্বের অন্যতম সমুদ্রতীরবর্তী ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এর বদৌলতে গত এক বছরে সুন্দরবন ভ্রমণে দেশি-বিদেশি পর্যটক বেড়েছে দ্বিগুণ। আর বিদেশি পর্যটক বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। পর্যটকবাহী বিলাসবহুল ভ্রমণতরির সংখ্যাও বেড়েছে।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন খুলনার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আযম ডেভিড বলেন, ‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন। যাকে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে রহস্য। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় পর থেকে রহস্যের সন্ধানে বনে অনেক বেশি পর্যটক ছুটে আসছেন।

খুলনার কয়রা উপজেলার কামরুল জানান, সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বলা হয়। কিছু জেলে বিভিন্ন সময় সুন্দরবনে পাস নিয়ে মাছ ধরতে যায়। তারা বনে গিয়ে বিষ দিয়ে মাছ ধরে। এদের প্রতিহত করতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।

কয়রা উপজেলার সুন্দরবনের নীলকমল অভয়ারণ্য কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবু সাঈদ বলেন, বনের মধ্যে মাটি তুলে উঁচু টিলা বানানো হয়েছে। পাশেই মিঠাপানির পুকুর খনন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি মাথায় রেখে পুকুরের চারপাশে উঁচু পাড় দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় বনবিভাগ কাজ করছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন নিজে ভালো থাকুক, আমাদের ভালো রাখুক এমনটাই আশা সবার।

প্রসঙ্গত, ২০০১ সালে খুলনায় অনুষ্ঠিত হয় ১ম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন। নানান প্রতিকূলতা পেরিয়ে সাফল্য পাওয়া সে সম্মেলনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। ২০০১ সালের সেই সুন্দরবন সম্মেলনের পরের বছর থেকেই খুলনাসহ সুন্দরবন সন্নিহিত জেলাগুলোতে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সুন্দরবন দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি এই দিবস পালনের কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত থাকে সুন্দরবন একাডেমি, বন বিভাগ, বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুন্দরবন সংলগ্ন সাংবাদিক সমাজ এবং প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ।

সারাবাংলা/আরআইটি/এনএস

খুলনা সুন্দরবন সুন্দরবন দিবস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর