Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফাগুনেও দেখা নেই মুকুলের, দুশ্চিন্তায় আমচাষিরা

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:৫২

রাজশাহী: শীত চলে গেছে মাত্র ১৩ দিনে হলো। ফাগুনের মাঝামাঝিতে ধীরে ধীরেই বাড়ছে তাপমাত্রা। যদিও দিনে গরম অনুভূত হলেও রাতে তা কিছুটা কমে আসছে। তবে প্রকৃতিতে এখনও আগুন রাঙা ফাগুনের দেখা মিলেনি। যদিও বসন্তের আবাহনে ইতোমধ্যে ফুটেছে পলাশ-শিমুল। কিন্তু সবুজ আম্রকাননে এখনও সেভাবে ঝিলিক দিচ্ছে না সোনালি মুকুল। আমের শহর ও রাজধানীখ্যাত রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই সময়ে যেখানে গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে থাকার কথা, সেখানে অধিকাংশ গাছই মেলতে পারেনি মুকুল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও তীব্র শীতই এর অন্যতম কারণ হতে পারে বলে জানিয়েছেন কৃষিবিদরা।

বিজ্ঞাপন

বসন্তের ফাগুন আর আমের মুকুল যেন একই সুতোয় গাঁথা। এরপরও বছরের নির্দিষ্ট এই সময়জুড়ে রাজশাহীর আমচাষি ও ব্যবসায়ীসহ কমবেশি সব শ্রেণির মানুষেরই নজর আম বাগানের দিকে। সদ্য মুকুল ফোটার এমন দৃশ্য এখন কংক্রিটের শহর থেকে শুরু করে বিস্তৃত গ্রামীণ জনপদেও। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার প্রায় সব এলাকাতেই এখন প্রচুর আমবাগান রয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন হচ্ছে। সেসব জাতের আমের বাগানও তৈরি হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে মিলছে আমের ফলনও। কিন্তু এখনও অধিকাংশ গাছে মুকুল না আসায় দুশ্চিন্তায় ভোগাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

দেশের অর্থনীতিতে আম লাভজনক মৌসুমি ফল ব্যবসা। তাই প্রতি বছরই বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। তবে গড়ে ওঠা নতুন আমবাগানগুলোর প্রায়ই বনেদি জাতের। বিশেষ করে নিয়মিত জাত ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত ও আশ্বিনা জাতের হাইব্রিড গাছই বেশি হচ্ছে।

সাধারণত মাঘের শেষেই আম গাছে মুকুল আসে। এবার তার ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেছে। আগে রাজশাহীতে আমের মৌসুমে ‘অফ ইয়ার’ এবং ‘অন ইয়ার’ থাকতো। অফ ইয়ারে ফলন কম হতো আর অন ইয়ারে হতো বেশি। কিন্তু প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে রাজশাহীর গবেষক ও আম চাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই রেওয়াজ ভেঙেছে। বছরজুড়ে চাষিদের নিয়মিত পরিচর্যার কারণে এখন রাজশাহীর সব বাগানেই প্রতিবছরই আমের আশানুরূপ ফলন হচ্ছে এবং বাড়ছেও।

সোনালি মুকুলে প্রতিবার ছেয়ে গেলেও এবার তা ব্যতিক্রম। বিগত বছরগুলোতে গাছজুড়ে মুকুলের আধিপত্যে থাকলেও এবার বাগানগুলো দেখে তাই আমচাষিদের মনে আশার প্রদীপ জ্বলছে না। প্রতিদিনই চলছে পরিচর্যা। আমগাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে উঁচু করে দেওয়া হচ্ছে সেচ। কিন্তু তাতেও তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘুরে আম গাছে আশারূনুপ মুকুল দেখা যায়নি। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলছেন, পুরোপুরিভাবে শীত বিদায়ের আগেই আমের মুকুল আসা খুব একটা ভালো ব্যাপার নয়। মাঝে-মধ্যেই ঘন কুয়াশা থাকছে প্রকৃতিতে। আর এমন হঠাৎ-হঠাৎ ঘন কুয়াশা আমগাছের মুকুলের কাল। এতেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে মুকুল। পাউডারি মিলডিউ রোগে আক্রান্ত হয়ে মুকুলের অধিকাংশই ঝরে যায়। যা পরে ফলনেও প্রভাব ফেলবে। যদিও প্রাকৃতিক নিয়মে ফাগুন মাসে ঘন কুয়াশার আশঙ্কা খুবই কম। এর পরও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করলে আমের মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

সরেজমিনে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, লক্ষণভোগ, খিরসাপাতের কিছু গাছে আমের গাছে মুকুল এলেও অন্যন্য অধিকাংশ গাছই ফুলহীন। এতে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে চাষিদের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর শহরের বিদিরপুর এলাকার আবুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার প্রায় ২৫টি আম গাছ আছে। প্রতিবছর মাঘের শেষে আমে মুকুল আসে। তবে এবার এখনও সেভাবে গাছে মুকুল আসেনি। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি মুকুল দেখা যেতে পারে।’

সদর উপজেলা ইসলামপুর ইউনিয়নের আম চাষি আশরাফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতবছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যেই সব গাছে মুকুল এসেছিল। কিন্তু চলতি বছরে ফেব্রুয়ারি মাস প্রায় শেষ। এখনও অধিকাংশ গাছে মুকুল নেই। দুয়েকটি গাছে মুকুল থাকলেও একেবারেই কম। আমরা স্প্রে ও সেচ দেওয়ার কোনো কমতি রাখিনি। শুনছি অতিরিক্ত শীতের কারণে নাকি এমনটা হয়েছে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার দীর্ঘমেয়াদী শৈত্য প্রবাহ, অতিরিক্ত শীতের কারণে আম গাছে মুকুল আসছে না। এতে আমাদের মনে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলেছে, সঠিক নিয়মে ও উপযুক্ত সেচ ও স্প্রেসহ অন্যান্য প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পারলে সামনে কিছু দিনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই মুকুল আসবে। শীত ও ঠাণ্ডার কোনো প্রভাব পড়বে না।’

রাজশাহীর পবার আম ব্যবসায়ী আবদুর রহিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘একবার ফলন হলেও বছরের প্রায় পুরোটা সময়টা আমবাগানের পরিচর্যায় চলে যায়। মাঘের শেষে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে আমের মুকুল আসে। তবে এবার আগেই আমের গাছে মুকুল এসেছে।’

রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার প্রায় ৩৫ শতাংশ আম গাছে মুকুল এসেছে। এসব গাছের আমের মুকুল রক্ষা ও সঠিক পরিচর্যায় বেশি যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক পলাশ সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘গেল বছর আম গাছে প্রচুর মুকুল ছিল। তাই চলতি বছরকে অফ সিজন বলা যায়। তবে শীতের প্রকোপে বিশেষ করে বড় গাছে আমের মুকুল কম এসেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছে। তবে এখন যদি গরমের প্রবণতা বাড়ে সেক্ষেত্রে মুকুল আরও ফুটতে পারে। কিন্তু সেই মুকুলে আমের ফলন তেমন ভালো হবে না।’ চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর জমিতে ৭৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮২৫ গাছ আছে বলে জানান তিনি।

এদিকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পোকার আক্রমণ থেকে আমের মুকুলকে বাঁচাতে আগাম কীটনাশক প্রয়োগসহ, গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন রাজশাহীর আমচাষি ও বাগান মালিকরা। মুকুল রক্ষা করতে গাছে গাছে ওষুধ স্প্রে করছেন অনেকে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবারও আমের বাম্পার ফলনের বাগান মালিকদের।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার রাজশাহীতে ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমির আমবাগানে দুই লাখ ৬০ হাজার ১৬৪ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সব প্রতিকূলতা পাশ কাটিয়ে এগোতে পারলে আম রফতানি বাড়ানো যাবে।’

সারাবাংলা/পিটিএম

আম আমচাষি ফাগুন মুকুল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর