‘পাশ ফিরলেই দেখি বড় বড় গান তাক করে রেখেছে’
১৪ মার্চ ২০২৪ ২১:০৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো : জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছার পর এক নাবিক পরিবারের সদস্যদের কাছে অডিওবার্তা পাঠিয়েছেন। এতে তিনি জিম্মি অবস্থায় তাদের দিনযাপন, জলদস্যুদের আচরণ এবং জাহাজে থাকা রসদ দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার কথা জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) দুপুর ১টার দিকে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজটি ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সোমালিয়া উপকূলবর্তী গারাকাদ বন্দর থেকে আনুমানিক সাত মাইল দূরে নোঙ্গর করে। এরপরই ওই নাবিক তার ছোট ভাইয়ের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে অডিওবার্তাটি পাঠান।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকা পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে ওই নাবিকের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে পরিবারের অন্তত দু’জন সদস্য বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অডিওবার্তাটি জাহাজের মালিকপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে পরিবারের এক সদস্য জানিয়েছেন।
ওই নাবিকের ভগ্নিপতি সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাহাজ নোঙ্গর করার পর খুবই গোপনে এবং সতর্কতার সঙ্গে পাঠানো একটি অডিওবার্তা আমাদের কাছে এসেছে। যেহেতু জিম্মি অবস্থায় থাকা সব নাবিকের মোবাইল জলদস্যুরা কেড়ে নিয়েছে, সেজন্য আমরা অডিওবার্তা প্রেরকের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাই না। কারণ, কেড়ে নেওয়ার পরও তার কাছে একটি মোবাইল সেট থেকে যাওয়ার বিষয় জলদস্যুরা জানতে পারলে তার ক্ষতি হতে পারে, এ আশঙ্কা আমরা করছি।’
মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একটি অডিওবার্তা পেয়েছি। সেটি আসলেই জাহাজের নাবিকের কি না সেটি আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি। তবে আমরা এখনও নিশ্চিত নই।’
জিম্মি জাহাজ উদ্ধারের চেষ্টা
অডিওবার্তায় জিম্মি নাবিক বলেন, ‘গতকাল (বুধবার) একটা নেভি জাহাজ আসছিল, এরপর আজকেও একটা আসছে। টোটাল দু’টি জাহাজ আমাদের রেসকিউ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এটা তো পসিবল না। কারণ, তখন তারা (জলদস্যু) আমাদের জিম্মি করে রাখে, আমাদের মাথায় গান ধরে রাখে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের তারা রেস্ট্রিক্টেড করে ফেলে।’
তিনি বলেন, ‘যখন নেভির বোট আসে, নেভির জাহাজ আসে…, বড় বড় ফ্রিগেট আসছে দুইটা, একদম সব ইক্যুইপমেন্ট নিয়ে। বাট ওরা এগুলোতে ভয় পায় না। কারণ, ওরা আমাদের জিম্মি করে রাখে, আমাদের মাথায় গুলি ধরে রাখে বা আমাদের রেস্ট্রিক্ট করে রাখে। তবে ব্যাপার হচ্ছে, এখন পর্যন্ত হার্ট করেনি।’
উদ্ধারের চেষ্টাকারী জাহাজগুলো কোন দেশের নৌবাহিনীর সেটা অডিওবার্তায় পরিষ্কার করা হয়নি। তবে বিদেশি গণমাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সামুদ্রিক নিরাপত্তাবাহিনী জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজটি উদ্ধারের চেষ্টা করেছিল বলে তথ্য দিয়েছে।
‘বড় বড় মেশিনগান তাক করে রেখেছে’
অডিওবার্তায় ওই নাবিক জানান, জিম্মি সবাইকে কেবিন থেকে বের করে জাহাজের ব্রিজে (ডেকের ওপর কাচের ঘেরা অংশ) ঘুমাতে দিয়েছে জলদস্যুরা। সবাইকে একটি ওয়াশরুম ব্যবহার করতে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই ব্রিজে ঘুমাই একসাথে, এরকম তো আমাদের অভ্যাস নেই। তারপরও এখন ঘুমাচ্ছি। সবাই একটা ওয়াশরুম ব্যবহার করি। যেটা সমস্যা, যেমন আমি যেখানে ঘুমাই, একপাশে হলে দেখা যায় না, আরেকপাশে হলে দেখি যে, আমার দিকে বড় বড় মেশিনগান, বড় বড় গান তাক করে রেখেছে। তো, এ অবস্থায় ঘুম যা হবার হচ্ছে আর কি! তারপরও সুস্থ আছি, একটু মানসিকভাবে ‘ইয়ে’ থাকলেও সুস্থ থাকার চেষ্টা করছি।’
মজুত খাবারে চলবে বড়জোড় ১৫ দিন
জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর মালিকপক্ষের কাছে পাঠানো অডিওবার্তায় চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান জানিয়েছিলেন, জাহাজে ২০ থেকে ২৫ দিনের খাবার এবং ২০০ টন বিশুদ্ধ পানি মজুত আছে।
তবে সর্বশেষ অডিওবার্তা পাঠানো নাবিক জানিয়েছেন, জলদস্যুরাও তাদের কাছ থেকে খাবার খাচ্ছেন এবং পানি ব্যবহার করছেন। ফলে মজুত খাবার দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
ওই নাবিক বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, এখনও খাবার-দাবার আছে। তবে যেহেতু, জলদস্যুরাসহ আমাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করছে, আমাদের পানি ব্যবহার করছে, আমাদের খাওয়া-দাওয়া কতদিন যায়, এটা বলতে পারছি না। ১০-১৫ দিন হয়তো বড়জোড় যেতে পারে। ১০-১৫ দিন পর খাওয়া-দাওয়া যখন আমাদের শেষ হয়ে যাবে, তখন আমরা খুব কষ্টে পড়ে যাব, পানি শেষ হয়ে গেলে খুব কষ্টে পড়ে যাব। এটাই হলো আমাদের পরিস্থিতি।’
‘আমরা ব্রিজে বসে আল্লাহ, আল্লাহ করি’
অডিওবার্তায় ওই নাবিক বলেন, ‘আমরা আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, সুস্থ আছি। কিন্তু মানসিকভাবে একটু বিপর্যস্ত। আজ (বৃহস্পতিবার) আমরা সোমালিয়া আসলাম। আসার পরে ওদের (জলদস্যু) সাথে আমাদের একটা ভালো রিলেশন হয়েছে। আমরা বলে-কয়ে একটু কেবিনে আসলাম। বাট পরে আবার ব্রিজে চলে যেতে হবে। কথা হচ্ছে যে, মানসিকভাবে আল্লাহ যতদিন শক্ত রাখে ততদিন আর কি !’
পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরাও ভালো থাকিও, সবাইকে আমাদের জন্য দোয়া করতে বলিও, আমরা যেন নিরাপদে আসতে পারি, আল্লাহ যেন আমাদের এটাকে সহজ করে দেয় রোজার উছিলায়। আমরা সবাই ব্রিজে বসে আল্লাহ, আল্লাহ করি আর কী! সবাই আল্লাহকে ডাকি। তো, দেখা যাক, আল্লাহ আমাদের ডাক যেন শুনে ইনশল্লাহ।’
আরও পড়ুন:
- ‘কী হবে কিছুই তো জানি না, দোয়া করো’
- জিম্মি জাহাজে ৫৫ হাজার টন কয়লায় ‘অগ্নিঝুঁকি’
- ‘মুক্তিপণ না দিলে একে একে সবাইকে মেরে ফেলা হবে’
- উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জিম্মি জাহাজের নাবিকদের স্বজনেরা
- ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে বাংলাদেশি জাহাজ
- ছেলেকে সুস্থ ফিরিয়ে দিন— জিম্মি নাবিকের মায়ের আর্তি
- নাজমুলকে ফিরে পেতে মায়ের আকুতি, বাবা হাসপাতালে
- জিম্মি জাহাজ সোমালিয়া উপকূলে, নাবিকরা অক্ষত আছেন
- জলদস্যুদের কবলে টাঙ্গাইলের সাব্বির, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পরিবার
- সোমালিয়ার পথে জিম্মি জাহাজ, এখনও ২৭৫ নটিক্যাল মাইল দূরে
তিনি আরও বলেন, ‘সবাই আমাদের জন্য দোয়া করছে। সরকারও যেহেতু পদক্ষেপ নিচ্ছে, আমাদের কোম্পানিও আল্লাহর রহমতে এ বিষয়ে সজাগ আছে, বিশ্বমিডিয়াও আমাদের বিষয়ে কথা বলছে। ইনশল্লাহ, আমরা আশা করি যে, শিঘ্রই পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারব। ঈদের আগেই ইনশল্লাহ যেন পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারি, এটা আমরা চাই আর কী ! তো দোয়া করো, যেন আল্লাহ আমাদের এই কঠিন যাত্রাকে সহজ করে দেন, তোমরা ভালো থাকিও, আসসালামুওয়ালাইকুম।’
জলদস্যুদের কবলে পড়া ‘এমভি আবদুল্লাহ’ নামে জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বাংলাদেশ সময় বেলা ১২টার দিকে ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজটি সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী, আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে জাহাজটি সংযুক্ত আরব-আমিরাতের দুবাইয়ের আল-হামরিয়া বন্দরে যাচ্ছিল। ১৯ মার্চ গ্রিনিচ সময় রাত ৮টায় জাহাজটি সেই গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা ছিল।
জাহাজে থাকা নাবিকেরা হলেন- জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্ম শ্মসুদ্দিন, মো . আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমওএ) জানিয়েছে, জিম্মি নাবিকদের মধ্যে ১১ জন চট্টগ্রামের ও ২ জন নোয়াখালীর। বাকি ১০ জন যথাক্রমে ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, খুলনা, নেত্রকোনা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বরিশাল জেলার।
সর্বশেষ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিএমএমওএ’র সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাহাজে থাকা সব নাবিক এখনও নিরাপদে আছেন। জলদস্যুরা এখন পর্যন্ত জাহাজ মালিকের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। আজ (বৃহস্পতিবার) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি সভা করেছে। এতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনার স্বার্থে বিষয়টি সমঝোতামূলকভাবে সম্পন্ন করা হবে। জাহাজের মালিকপক্ষও সভায় তাদের আগের জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে তারা জলদস্যুদের সঙ্গে দ্রুত নিগোশিয়েট করার চেষ্টা করছেন বলে জানান।’
জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কেএসআরএম গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে তিনটা পক্ষ আছে। আমরা একটা পক্ষ, আমাদের সঙ্গে দেশের সরকার আছে। আরেকটি পক্ষ বিমা প্রতিষ্ঠান এবং জলদস্যুদের প্রতিনিধি হিসেবে তৃতীয় পক্ষ। আমাদের সঙ্গে মূলত যোগাযোগ হবে তৃতীয় পক্ষের। আগেও আমাদের একটি জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। তখন দেখেছি, জলদস্যুরা জাহাজ সেইফ জোনে না নেওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না। এবারও সেইফ জোনে নেয়ার পর তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হতে পারে বলে ধারণা করছি।’
এরপরও মালিকপক্ষে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু তাদের থার্ড পার্টির সন্ধান তো আমাদের পেতে হবে। আমরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করেছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। সরকারিভাবে এ বিষয়ে আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে দাফতরিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে।’ নাবিকদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে অক্ষত অবস্থায় ফেরত আনার বিষয়ে কেএসআরএম’র অবস্থান অটুট আছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, কেএসআরএম গ্রুপের মোট ২৩টি জাহাজ আছে। যেগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করছে। গোল্ডেন হক নামে পরিচিত এমভি আবদুল্লাহ গত বছর কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানায় আসে।
এর আগে, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতের উপকূলে আরবসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি’। ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম