ফেসবুকে বয়কট, প্রভাব নেই ঈদ পোশাকের বাজারে
৩১ মার্চ ২০২৪ ২২:১১
ঢাকা: ভারতীয় পোশাক বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ফেসবুক সরব ‘বয়কট’ প্রচারে। দেশের সবচেয়ে বড় দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও বয়কটের পক্ষে-বিপক্ষে মুখ খুলছেন নিয়মিতই। কিন্তু ঈদুল ফিতর সামনে রেখে রাজধানীর পোশাকের বাজারে তার খুব একটা প্রভাব নেই। যথারীতিই ঈদের বাজারে যেসব পোশাক বিক্রি হচ্ছে তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশই ভারতীয়।
ঢাকার একাধিক এলাকার বিভিন্ন মার্কেট ও শপিং মলে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, পোশাক কেনার সময় সেটি কোন দেশের, তা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই অধিকাংশর। আর দোকানিরা বলছেন, ঈদের বাজার সামলানোর মতো পর্যাপ্ত পোশাক দেশে উৎপাদনই হয় না।
রাজধানী ঢাকার বসুন্ধরা সিটি, নিউ মার্কেট, খিলগাঁওয়ের তালতলা সুপার মার্কেট ও বেইলি রোডের বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেল এমন চিত্র। এসব মার্কেট ও শপিং মলে পোশাকের দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেল, নারী, শিশু ও পুরুষের জমকালো নকশার অধিকাংশ পোশাকই ভারতীয়। এমনকি পাকিস্তানি ব্র্যান্ডের অনুকরণে বানানো অনেক পোশাকও আসে ভারত থেকে। আর ঈদের বাজারে এগুলোর চাহিদার কমতি নেই।
অথচ অনলাইন-অফলাইনে কয়েক সপ্তাহ ধরে আলোচিত ইস্যু ‘বয়কট’। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকেই ভারতবিরোধী প্রচারণা ‘ইন্ডিয়া আউট’ ও ‘বয়কট ইন্ডিয়ান প্রোডাক্টস’ লক্ষ করা যাচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউব ও এক্সে (সাবেক টুইটার)। বাংলাদেশে ভারতের ‘আগ্রাসনে’র প্রতিবাদে ভারত ও ভারতীয় পণ্য বর্জনই এসব প্রচারণার মূল কথা।
‘বয়কট ইন্ডিয়ান প্রোডাক্টস’ ক্যাম্পেইনে নিজেদের যুক্ত করে নিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারাও। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী থেকে শুরু করে সব নেতাই ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন দেশবাসীর প্রতি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি নেতাদের এই আহ্বানকে সমালোচনা করেছেন। খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি নেতাদের স্ত্রীদের আলমারিতে যেসব ভারতীয় শাড়ি রয়েছে সেগুলো বিএনপি নেতারা পুড়িয়ে দেখালে তবেই তিনি বিশ্বাস করবেন যে বিএনপি নেতারা ভারতীয় পণ্য সত্যিকার অর্থে বর্জন করছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর লেখালেখি চলছে। অনেকেই এই আহ্বানকে সমর্থন দিচ্ছেন, অন্যদেরও ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে বলছেন। বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ দিয়ে চলছে ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রচার। কিন্তু বাজারে এর প্রভাব পড়ছে কতটুকু?
বিভিন্ন মার্কেট ও শপিং মল ঘুরে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় পোশাকের উপস্থিতি রয়েছে আগের মতোই। বেচাকেনাও কম নয়। শিশু থেকে শুরু করে ছেলে-মেয়ে সবার জন্যই ভারতীয় পোশাক রয়েছে বাজারে।
বেইলি রোডের বেশ কয়েকটি পোশাকের দোকানে দেখা গেল ভারত থেকে আসা ছেলেদের জমকালো নকশার অ্যামব্রয়ডারি করা পাঞ্জাবি। দেশীয় নানা ব্র্যান্ডের নামের লোগো বসালেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো ভারতীয় পোশাক।
বেইলি রোডের ক্যাপিটাল মার্কেটে ছেলেদের পোশাকের বেশ নামকরা একটি ব্র্যান্ডের শোরুমে কথা হয় একজন বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা বলি দেশে তৈরি। কিন্তু আসে তো ভারত থেকেই। ভারত থেকে পোশাক না আসলে আমরা ব্যবসা করব কীভাবে? এসব কাপড় দেশে পাওয়াই যায় না।’
একই চিত্র দেখা যায় অন্যান্য মার্কেটেও। এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাঞ্জাবি মিলছে নন-ব্র্যান্ড দোকানগুলোতে। বসুন্ধরা সিটিতে পুরান ঢাকা থেকে পাঞ্জাবি কিনতে আসা দুই বন্ধু জানালেন, পাঞ্জাবি ব্র্যান্ড বা দেশ নয়, নকশা আর কাপড় দেখে পাঞ্জাবি কেনেন তারা। নকশা দেখে এবং কাপড় হাতে ধরে যদি ভালো লাগে, সেই পাঞ্জাবিই কিনবেন তারা।
একই কথা বললেন দোকানদাররাও। তারাও বলছেন, বয়কটের কোনো প্রভাব ঈদের মার্কেটে বেচাকেনায় নেই। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের তুলনায় সব পোশাকের দামই কিছুটা বেশি। এর প্রভাবে বিক্রি কিছুটা কম।
মেয়েদের পোশাকের বাজারেও একই চিত্র। উৎসব সামনে রেখে মেয়েদের জন্য তৈরি ভারতীয় পোশাকের বিক্রি আগে থেকেই বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানি পেশাকও জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু পার্টিতে পরার উপযোগী গাউন, লেহেঙ্গা, থ্রিপিস, ঘারারা, সারারা ও শাড়ির বাজারে বাংলাদেশে ভারতের পোশাকের আধিপত্য একচেটিয়া। অন্যদিকে থ্রি-পিসের জন্য অনেক তরুণীর পছন্দ পাকিস্তানি ব্র্যান্ড আগা নূরসহ আরও কিছু পোশাক। এগুলোর প্রথম বা দ্বিতীয় রেপ্লিকাতে বাজার সয়লাব। তবে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এসব রেপ্লিকাও অনেক ক্ষেত্রেই ভারতে তৈরি।
বসুন্ধরা সিটি ঘুরে দেখা যায়, তাঁত ও দেশি শাড়ির দোকানগুলোর তুলনায় অন্য পোশাকের দোকানগুলোতে ভিড় বেশি। উৎসবমুখী দেশি শাড়ি ও অন্যান্য পোশাকের দাম তুলনামূলক বেশি। অন্যদিকে ভারতীয় দিল্লি বুটিকসসহ অন্যান্য ব্র্যান্ডের পোশাকের নানা মানের রেপ্লিকা ড্রেস সহজলভ্য, যেগুলোর দামও হাতের নাগালেই।
বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ভারী নকশাসমৃদ্ধ একটি ভারতীয় থ্রিপিস পাঁচ হাজার টাকার কিছু কমবেশিতে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু একই ধরনের ভারী নকশার দেশীয় থ্রিপিসের দাম পড়ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আবার দেশি সেই পোশাকের কাপড় নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। ক্রেতাদের অভিমত, সে তুলনায় ভারতীয় জর্জেট ও অন্যান্য সিনথেটিক কাপড় অনেক বেশি টেকসই ও ঝলমলে। সে কারণেই ঈদে ভারতীয় পোশাকই বেছে নেন অনেক ক্রেতা।
খিলগাঁও থেকে বসুন্ধরা সিটিতে পোশাক কিনতে এসেছিলেন সালমা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঈদের সময় একটু ঝলমলে কাপড় না হলে ভালো লাগে না। জর্জেট, সিল্ক বা কাতানের ওপর কাজ করা ঝলমলে গাউনই ভালো লাগে।’
বসুন্ধরা সিটির একটি শাড়ি ও লেহেঙ্গার দোকানে দেখা গেল সবই ভারতীয় পোশাক। দেশি কোনো পোশাক আছে কি না— জিজ্ঞাসা করতেই বিক্রেতা মুজাহিদ বলেন, ‘এগুলো দেশে বানায়ই না। দেশের ৯০ শতাংশ কাপড়ই আসে ভারত থেকে। কয়টা মানুষ দেশি কাপড় কেনে? কাস্টমাররা আসে, ১০-১৫ হাজার টাকা দিয়ে জামা কিনে নিয়ে চলে যায়। কোন দেশের, জিগায়ও না।’
তালতলা মার্কেটে কিছুটা কম মূল্যের পোশাক পাওয়া যায়। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সব ধরনের ক্রেতারই আনাগোনা এই মার্কেটে। পোশাকের ক্ষেত্রে দামটাই এখানে মুখ্য। তিন বছরের মেয়ের জন্য গেঞ্জি দরদাম করছিলেন শিল্পী খাতুন। সিপাহিবাগ থেকে আসা এই নারী বলেন, ‘বয়কট তো বুঝি না আপা। মেয়ের জন্য একটা ফ্রক কিনতে আসছিলাম। দাম ম্যালা, তাই গেঞ্জি কিনতে আসছি। গরমে পরে আরাম পাইব।’
এদিকে শিশুদের ফ্রকের বাজারেও ভারতীয় পোশাকেরই আধিক্য। চীন থেকে আসা কিছু পোশাকও জায়গা করে নিচ্ছে বলে জানালেন বিক্রেতারা। তবে এখনো দোকানগুলোতে ভারতীয় পোশাকই আধিপত্য ধরে রেখেছে। সেই আধিপত্য খর্ব করার মতো কোনো ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন না বলেই মন্তব্য দোকানিদের।
এদিকে বয়কট নয়, নিজেদেরর পছন্দেই দেশীয় পোশাক কিনে থাকেন অনেক ক্রেতা। তারা বলছেন, গরমে পরার জন্য দেশি সুতি, সিল্ক ও খাদি কাপড়ই আরামদায়ক। তাদের অনেকে ঝলমলে ও ভারী কাজের নকশাদার পোশাকের বদলে হালকা নকশার পোশাক পছন্দ করেন। রোজার শুরু থেকেই আড়ং, ইয়েলো, ইনফিনিটি, লা রিভের মতো দেশি ব্র্যান্ডের শো-রুমগুলোতেও তাই তীব্র ভিড় দেখা যায়। কে-ক্রাফট, অঞ্জনস, রঙ, দেশালের মতো ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে গড়ে ওঠা দেশি দশের রয়েছে নিজস্ব ক্রেতাগোষ্ঠী।
হাই এন্ড ব্র্যান্ডের পাশাপাশি অনেক তরুণ উদ্যোক্তার হাত ধরে গড়ে উঠেছে সামর্থ্যের মধ্যে থাকা দেশি ব্র্যান্ড। শরদিন্দু, ভারমিলিয়নের মতো অনলাইন থেকে অফলাইনে যাত্রা করা প্রতিষ্ঠানের ভিড় দেখে বোঝা যায়, রঙ ও নকশায় বৈচিত্র্য থাকলে ও দাম সাধ্যের মধ্যে থাকলে মানুষ দেশি পোশাকও কেনে আগ্রহ নিয়েই।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
ঈদ বাজার ঈদুল ফিতর ঈদের পোশাক বয়কট বয়কট ইন্ডিয়া বয়কট ইন্ডিয়ান প্রোডাক্ট ভারতীয় পণ্য বর্জন ভারতীয় পোশাক