‘ওরা যেদিন মুক্ত হবে সেদিনই আমাদের ঈদ’
১১ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:২৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে বন্দি ২৩ বাংলাদেশি নাবিক। বন্দিত্বের সময় এরই মধ্যে মাস পার হয়েছে। তাদের মুক্তির প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে আছেন উদ্বেগাকূল স্বজনেরা। তাদের ঘরে আসেনি ঈদ। বাবার হাত ধরে কিংবা ভাইয়ের সঙ্গে মিলে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করতে যাওয়া হয়নি কারও। তাদের আনন্দ আয়োজন যেন বন্দি হয়ে আছে পাঁচ হাজার নটিক্যাল মাইলেরও বেশি দূরে সোমালিয়া উপকূলে। জিম্মি নাবিকদের স্বজনেরা বলছেন, তারা যেদিন মুক্ত হবেন সেদিনই হবে তাদের ঈদের দিন।
বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) মুসলমানের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের আনন্দ আয়োজনে মেতেছে বাংলাদেশ। তবে ঈদ আসেনি এ ২৩ নাবিকের ঘরে।
নগরীর আসকার দিঘীর পাড়ে নাবিক আইনুল হকের বাসায় ঈদের আয়োজন দূরে থাক, বাসাটিতে যেন শোকের আবহ। মা লুৎফে আরা বেগম কাঁদছেন। ভাইয়ের চোখও ছলছল।
লুৎফে আরা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজ ঈদের দিন। কিন্তু সেই আনন্দ আমাদের নেই। ঈদের আনন্দ আমাদের নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার ছেলে ফিরে আসবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোনো ঈদ নেই। আমার ছেলে বন্দি, আমি মা হয়ে কীভাবে ঈদ করব! আমাদের সন্তানরা ফেরত এলেই আমাদের ঈদ হতো।’
আইনুল হকের সঙ্গে সর্বশেষ বুধবার দুপুরে তার পরিবারের কথা হয়েছে। সোমালিয়ায় জিম্মি এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে এ দিন আইনুলসহ নাবিকরা ঈদের নামাজ আদায় করেন। জলদস্যুদের সশস্ত্র প্রহরায় নামাজ আদায়ের পর পরিবারের সদস্যদের মন ভালো করতে একসঙ্গে হাসিমুখে তোলা ছবিও পাঠান তারা।
আরও পড়ুন-
- বাবার সঙ্গে ঈদ করতে চায় আসফিয়া
- সাইদুজ্জামান জিম্মি সোমালিয়ায়, বাড়িতে ঈদ রঙহীন
- জিম্মি নাবিক সাইদুজ্জামানের সঙ্গে কথা হচ্ছে পরিবারের
- ঈদের একদিন আগে হলেও আব্বু আসবে— প্রতীক্ষায় মেয়েরা
- বন্দুকের নলের মুখে ঈদের নামাজ, পরিবারের জন্য হাসিমুখে ছবি
তবে মুখে যতই হাসি থাকুক, আইনুলরা ভালো নেই বলে জানান লুৎফে আরা বেগম। তিনি বলেন, ‘গতকাল (বুধবার) কথা হয়েছে। বলছে, ভালো আছে। আমরা তো বুঝি কতটা ভালো আছে। খাবার পাচ্ছে, কিন্তু পানির সংকট দেখা দিয়েছে জাহাজে। পরিমাণমতো পানি পাচ্ছে না। নিয়মিত গোসল করতে পারছে না, সপ্তাহে দুই দিন করে গোসল করছে। খাবার পানিও কম পাচ্ছে। ওদের (জলদস্যু) ফোন করতে দেয়, ইচ্ছা না হলে দেয় না।’
আইনুলের ছোট ভাই মাইনুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবছর ঈদের নামাজ পড়ে এসে আব্বুকে সালাম করতাম। ভাইকে সালাম করে কোলাকুলি করতাম। আব্বু মারা গেছেন। এ বছর আব্বু নেই, ভাইও পাশে নেই। আমাদের জন্য ঈদ আসেনি। আমার ভাই যেদিন ফিরে আসবে, সেদিনই হবে আমাদের জন্য ঈদের দিন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার ভাই ফিরে আসুক, এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া।’
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা নাবিক নুরুদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস আর তার আড়াই বছরের ছেলে সাদ বিন নুরের জন্যও আসেনি ঈদ। বুধবার (৯ এপ্রিল) বিকেলে নুরুদ্দিন ফোন করেছিলেন স্ত্রীকে। তখন ছেলের ‘পাপ্পা’ ডাকটা কয়েকবার শোনানো হয় তাকে। ছেলেও বাবার কণ্ঠস্বর শোনে। সেই থেকে সাদ বিন নুর শুধু কাঁদছে আর ‘পাপ্পা, পাপ্পা’ বলে ডাকছে।
জান্নাতুল ফেরদৌস সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের মানসিক অবস্থা ভালো নেই। ঈদের আয়োজন আর কী করব, রিচুয়াল যতটুকু না করলেই নয়, সেটুকুই করছি। ওরা যেদিন মুক্ত হয়ে আসবে, সেদিনই ঈদ সেলিব্রেট করব। ওরা যেদিন মুক্ত হবে, সেদিনই হবে আমাদের ঈদ। আমার ছেলেটা একটু একটু বুঝতে শিখেছে। পাপ্পা, পাপ্পা করে মাঝে মাঝে ডাকে আর কান্না করে।’
জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান বুধবার ঈদের নামাজ আদায়ের পর পরিবারের কাছে অডিওবার্তা পাঠান। সেখানে ঈদের সময় দেশ ও স্বজনদের ছেড়ে থাকার কষ্টের কথা বলেছেন তিনি। তাদের গ্রামের বাড়ি চন্দনাইশ উপজেলায়। বাসা নগরীর নন্দনকাননে।
অডিওবার্তায় আতিক বলেন, ‘মনকে আমরা আরেকবার শক্ত করলাম। কারণ এখন পরিস্থিতিই তো নিজেকে সামলে নেওয়ার। নিজেকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে এ জিম্মিদশার সাথে…। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে আল্লাহ রব্বুল আলামিন এ জিম্মিদশার মধ্যেও সুন্দর ও সুস্থভাবে রোজা ও তারাবি নামাজ করার তৌফিক দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, এটা আল্লাহর একটা রহমত।’
‘শুরুতে জলদস্যুরা কঠোর আচরণ করলেও পরে তারা আমাদের নামাজ, রোজাসহ বিভিন্ন কাজে কিছুটা ছাড় দিত। দিনের বেলা কেবিন ও রাতে সবাইকে ব্রিজে থাকার অনুমতি দেওয়া হলো। সপ্তাহে একদিন স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুমতিও দিলো। এর বাইরে দুম্বা এবং রসদ সাপ্লাইয়ের বিষয়টি ছিল কমন ব্যাপার। এটা সাধারণত সব জিম্মি জাহাজের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। পরিস্থিতির কারণে এখন আমরা সবাই যেমন দুম্বার মাংস খেতে অভ্যস্ত হয়েছি। তেমনি সপ্তাহে একদিন পানি ব্যবহারেও অভ্যস্ত হয়েছি,’— বলেন আতিক।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় সময় দস্যুদের টেস্ট ফায়ারিংয়ের শব্দে পুরো জাহাজ কেঁপে ওঠে। এটাও এখন আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। গাদাগাদি করে ব্রিজের ফ্লোরে রাত কাটানোর অভ্যাসও আমাদের হয়ে গেছে। ইনশাল্লাহ সামনের দিনগুলোতে আমরা সারভাইভাল টেকনিক অ্যাপ্লাই করে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করব।’
আতিকুল্লাহর ছোট ভাই আবদুল নুর খান আসিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল অডিওবার্তাটা শুধু পেয়েছি। আজ ঈদের দিন। আজ যদি একটু কথা বলতে পারতাম! আমার আম্মা, ভাবি, উনার তিন মেয়ে— সবাই একটু কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। সবাই গ্রামের বাড়িতে এসেছি। আসতে হয় বলে আসা। আমাদের ঈদের আনন্দ নেই। টেনশনের মধ্যে কী আনন্দ করা যায়! আমার ভাই আগে ফেরত আসুক, তারপরই আমাদের ঈদ হবে।’
এমভি আবদুল্লাহ নামে জাহাজটি গত ১২ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজটি সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। ওই জাহাজের ২৩ নাবিককে জিম্মি করা হয়। জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন।
জাহাজে থাকা নাবিকেরা হলেন— জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুরুদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।
কেএসআরএম গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নাবিকদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত আছে। তাদের মুক্ত করার বিষয়ে আমাদের আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে দ্রুতই আমরা নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে পারব।’
নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জিম্মি ২৩ নাবিকের মধ্যে ১৬ জন মুক্তির পর দুবাই থেকে দেশে ফেরার আগ্রহের কথা ক্যাপ্টেনকে জানিয়েছেন। বাকি সাতজন চট্টগ্রাম বন্দরে এসে সাইন অফ (জাহাজের কর্ম থেকে অব্যাহতি) নিতে চান। কিন্তু অধিকাংশ নাবিক পরিবার চান, তারা সংযুক্ত আরব-আমিরাতের বন্দরে সাইন অফ করে দুবাই বিমানবন্দর থেকে বিমানে দেশে আসুক।
জানা গেছে, জলদস্যুদের সঙ্গে আলোচনা ও মুক্তির প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির পর জাহাজের মালিকপক্ষ নাবিকরা কোথা থেকে সাইন অফ করবেন, সেটা জানানোর জন্য ক্যাপ্টেনকে নির্দেশনা দেন। সে অনুযায়ী ক্যাপ্টেন গত ৯ এপ্রিল একটি তালিকা পাঠান। এতে ১৮ জন দুবাই বিমানবন্দর দিয়ে এবং পাঁচজন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে দুজন নাবিক তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টে চট্টগ্রাম বন্দরেই সাইন অফ নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান।
এক নাবিকের স্ত্রী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্যাপ্টেন চান, সব নাবিক চট্টগ্রাম বন্দরে এসে সাইন অফ করুক। কিন্তু আমরা চাই, তারা কয়লা খালাসের পর জাহাজ ফেরার জন্য যেন আর অপেক্ষা না করে। তারা যেন দুবাই এয়ারপোর্ট দিয়ে ফ্লাইটে দেশে ফেরত আসে। কারণ তাদের মানসিক অবস্থা ভালো নেই। জাহাজে করে ফিরতে সময় লাগবে। তাদের যত দ্রুত ফেরত আনা যায়, ততই ভালো হবে। এ জন্য আমরা চাই, তাদের দুবাই এয়ারপোর্ট করে ফ্লাইটে যেন নিয়ে আসা হয়।’
এর আগে, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর আরব সাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মণি। ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
ঈদুল ফিতর জলদস্যু জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জিম্মি জাহাজ জিম্মি নাবিক সোমালিয়া