বিজ্ঞাপন

ঈদের একদিন আগে হলেও আব্বু আসবে— প্রতীক্ষায় মেয়েরা

April 7, 2024 | 6:43 pm

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ‘আব্বু জাহাজে। ঈদের একদিন আগে হলেও আসবে।’— এভাবেই বাবার প্রতীক্ষায় থাকার কথা ব্যক্ত করল ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ’র চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের আট বছর বয়সী মেঝ মেয়ে উমাইজা মাহাবিন।

বিজ্ঞাপন

আতিকুল্লাহ খানের তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ইয়াশারিয়া ফাতিমা মেমন গ্রামার স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী আর মেঝ মেয়ে উমাইজা মাহাবিন একই স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে খাদিজা আরবিয়ার বয়স মাত্র দুই বছর।

বাবা এলে একসঙ্গে ঈদ করবে এই অপেক্ষা নিয়ে এখনও ঈদের শপিং করতে যায়নি তারা। এর মধ্যে দুই বছর বয়সী ছোট খাদিজা দরজায় কেউ কলিং বেল বাজালেই দৌড়ে যায়। এ বুঝি বাবা এলো! এরপর তাকে কোলে নিয়ে গালে ও কপালে চুমু দিয়ে বাবা আদর করবেন। কিন্তু দরজা খুলে যখন বাবাকে আর দেখতে পায় না তখন সে অভিমানে দৌড়ে গিয়ে মায়ের আঁচলে মুখ লুকায়।

রোববার (৭ এপ্রিল) সকালে নগরীর নন্দনকাননের রথেরপুকুর পাড় এলাকার সুবর্ণা ফরিদ টাওয়ারের তৃতীয় তলায় আতিকুল্লাহ খানের বাসায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। পেশাগত কাজে প্রায় সবসময় জাহাজে থাকায় বাবাকে তেমন কাছে পায় না তিন বোন। তবে কাছে না পেলেও প্রতিদিন কল দিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেন আতিকুল্লাহ। কিন্তু গত এক মাস ধরে বাবার সঙ্গে কোনোভাবেই কথা বলতে পারেনি তারা তিন জন।

বিজ্ঞাপন
ছবি: এমভি আবদুল্লাহ’র চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ

ছবি: এমভি আবদুল্লাহ’র চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ

সর্বশেষ শুক্রবার (৫ এপ্রিল) সন্ধ্যায় স্যাটেলাইট কল দিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন আতিকুল্লাহ। দুই মিনিটের আলাপে মা, স্ত্রী ও ভাইয়ের সঙ্গে তিনি কথা বললেও তিন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। দুই বছর বয়সী খাদিজার কাছে এটা তেমন কিছু না হলেও অন্য দুইবোন কিছুটা মন খারাপ করে আছেন।

আট বছর বয়সী উমাইজা মাহাবিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাবা জাহাজ থেকে এসেই আমাদের সবাইকে কোলে নিয়ে আদর করতেন। জাহাজে থাকলে প্রতিদিন কল দিয়ে কথা বলতেন। গত একমাস বাবার সঙ্গে কথা হয়নি।’

ঈদে কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে? এমন প্রশ্ন করলে চুপ হয়ে যান ছোট্ট উমাইজা। পরে উমাইজা বলেন, ‘ঈদের একদিন আগে হলেও আব্বু আসবেন। আব্বু এলে ঘুরতে যাব।’

বিজ্ঞাপন

একই উত্তর দেন বড় মেয়ে ইয়াশারিয়া ফাতিমা। ইয়াশরিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আব্বু এলে ঈদ করব, ঘুরব। আমরা জানি আব্বু আসবে। আমরা আব্বুকে অনেক মিস করছি।’

আরও পড়ুন: ছেলেকে সুস্থ ফিরিয়ে দিন— জিম্মি নাবিকের মায়ের আর্তি

ভালোভাবে কথা বলতে না পারলেও দুই বছর বয়সী খাদিজা আরবিয়া বলেন, ‘আব্বু আসবে।’ পরে দাদি শাহনূর আক্তারের কোলে শুয়ে পড়ে সে। এ সময় শাহনূর আক্তার তার বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে সে আস্তে করে বলে আতিকুল্লাহ।

আতিকুল্লাহ’র পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধা মা শাহনূর আক্তার তার তিন নাতনিকে নিয়েই কোনোভাবে দিন পার করছেন। আতিকুল্লাহ’র পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মিনা আজমাইন নিজেকে আগের থেকে অনেকটা শক্ত করেছেন। অসুস্থ হলেও স্বামীকে সুস্থভাবে ফিরে পেতে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছেন। বড় ভাইয়ের অবর্তমানে আগে থেকেই পুরো পরিবার একাই দেখভাল করে আসছিলেন ছোট ভাই আবদুন নূর আসিফ। কিন্তু পরিবারের এমন বিপদে তার দায়িত্ব ও কাজের ভার যেন আরও বেড়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

সবাই ঈদ আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও আতিকুল্লাহ’র পরিবারের মাঝে নেই তেমন কোনো আমেজ। এখনও শপিং করতে বের হননি পরিবারের কোনো সদস্য।

ছবি: এমভি আবদুল্লাহ’র চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ’র মা ও তিন মেয়ে

ছবি: এমভি আবদুল্লাহ’র চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ’র মা ও তিন মেয়ে

জানতে চাইলে শাহনূর আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যদি কোনো সমস্যায় থাকে তাহলে কী আর ঈদের আমেজে থাকা যায়! এখনও ঈদ নিয়ে কিছু চিন্তা করিনি আমরা। তবে ছোটদের এসব কিছু বুঝতে দিচ্ছি না। আত্মীয় স্বজনরা উপহার দিচ্ছে। তারা দেখভাল করছে। ছোট ছোট মাছুম বাচ্চারা বাবার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করছে। কখন তাদের আব্বু আসবে। আমাদের সঙ্গে মোবাইলে দুয়েক মিনিট কথা হলেও তারা বলতে পারে না।’

জাহাজে পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে শাহনূর আক্তার বলেন, ‘সর্বশেষ শুক্রবার আমার ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। স্যাটেলাইটে কল দিয়ে সে দুই মিনিট কথা বলেছিল। সেখানে তারা ভালো আছে বলে জানিয়েছে। তবে জাহাজের পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। তারা সবাই হিসেব করে পানি ব্যবহার করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জাহাজের মালিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন এক মাসের মধ্যে হয়তো কিছু একটি হতে পারে। তারা দস্যুদের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০-২৫ দিনের মধ্যে আমার ছেলে ছাড়া পেতে পারে বলেও আমাকে আশ্বস্ত করেছেন তারা। আমার বৌমা অসুস্থ। এ সময় তার পাশে আতিকের থাকা উচিত ছিল।’

ছবি: এমভি আবদুল্লাহ’র চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ’র মা ও তিন মেয়ে

ছবি: এমভি আবদুল্লাহ’র চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ’র মা ও তিন মেয়ে

আতিকুল্লাহ’র ছোট ভাই আবদুন নূর আসিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুক্রবার ইফতারের পর ভাইয়া কল দিয়েছিলেন। ভালো আছেন বলে তিনি আমাদের জানিয়েছেন। পরিবারের সবাইকে সাহস জোগাচ্ছি। এ ছাড়া তো আর কিছু করার উপায় নেই।’

পাপ্পা’র অপেক্ষায় ছোট্ট সাদ

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ’র নাবিক নুরুদ্দিনের ছোট পরিবার। স্ত্রী, মা ও আড়াই বছর বয়সী একমাত্র ছেলে সাদ বিন নূর। দু’দিন পর ঈদ হলেও নুরুদ্দিনের বাসার গেইটে যেন এখনও কড়া নাড়েনি সে আমেজ। তাই নুরুদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস স্বামীর বাড়ি ছেড়ে একমাত্র ছেলে ও শাশুড়িকে নিয়ে উঠেছেন বাবার বাড়িতে।

জান্নাতুল ফেরদৌস সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের জন্য এবার ঈদ আসেনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যখন সশরীরে উপস্থিত নেই তখন আর কি ঈদ পালন করব। আমার ছেলে ঘুম থেকে উঠে ও ঘুমাতে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করে তার পাপ্পা কোথায়। আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। ছোট সন্তান তার বাবাকে ছাড়া এবার ঈদ পালন করবে। ঈদের শপিংও আমরা করিনি। ঘরে যে কোলাহল ছিল সেটা নিমিষেই হারিয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুক্রবার শেষবার আমার সঙ্গে উনার কথা হয়েছে। আগের চেয়ে ভালো আছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। খাবার শুধু সেহরী আর ইফতারেই সীমাবদ্ধ সবাই। কারণ খাবার শেষ হয়ে গেলে আর পাবে না। খাবার পানিও শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।’

ছবি: এমভি আবদুল্লাহ’র নাবিক নুরুদ্দিন পরিবারসহ

ছবি: এমভি আবদুল্লাহ’র নাবিক নুরুদ্দিন পরিবারসহ

নুরুদ্দিনের স্ত্রী বলেন, ‘ছেলেও তার বাবার সঙ্গে কথা বলেছে। বাবা ছেলের ৩০ সেকেন্ডের আলাপে সাদ শুধু পাপ্পা, পাপ্পা বলেছে। কেএসআরএম কর্তৃপক্ষও তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।’

এদিকে, শনিবার (৬ এপ্রিল) সকালে চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানজি পুকুর পাড়ে নিজ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে নাবিকদের ঈদের আগে ফেরত আনার জন্য স্বজনদের আবেদনের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘জাহাজে যারা চাকরি করে, ঈদের আগে-পরে হিসেব করে তাদের কোনো ছুটি হয় না। তারা যায় ছয় মাস কিংবা এক বছরের জন্য। এই জাহাজ যদি হাইজ্যাক না-ও হতো, তাদের ঈদের আগে জাহাজ ছেড়ে পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার কথা ছিল না।’

নাবিকদের মুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যারা হাইজ্যাক করেছে, তাদের সাথে আলাপ আলোচনা চলছে। নাবিকরা ভালো আছে। তাদের খাবারের কোনো অসুবিধা নেই, তারা কেবিনে আছে। যেহেতু আলোচনা অনেকদূর এগিয়েছে, আমরা আশা করছি দ্রতই তাদের মুক্ত করা সম্ভব হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সে জাহাজের আশেপাশে বিদেশি জাহাজও প্রস্তুত আছে। আলোচনার পাশাপাশি হাইজ্যাকারদের ওপর নানামুখী চাপও রয়েছে। আমরা আশা করছি, দ্রুতই জাহাজ এবং নাবিকদের মুক্ত করা সম্ভব হবে। তবে দিনক্ষণ বলা সম্ভব নয়।’

এমভি আবদুল্লাহ নামে জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। গত ১২ মার্চ বেলা ১২টার দিকে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজটি সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। ওই জাহাজের ২৩ নাবিককে জিম্মি করা হয়।

জাহাজে থাকা নাবিকেরা হলেন- জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো . আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।

যেকোনো মুহূর্তেই নাবিকরা ছাড়া পাবেন জানিয়ে কেএসআরএম গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ঈদের পরই আমরা নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে পারব। যে কোনো মুহূর্তেই তারা ছাড়া পেতে পারেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘নাবিকদের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনই কথা হচ্ছে। তারা সবাই ভালো আছেন। জাহাজে পানি একটু কমে যাওয়ায় রেশনিং করে তারা ব্যবহার করছে। আর তারা যদি কোনো সংকটে পড়েন আমরা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব।’

এর আগে, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর আরবসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি’। ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটোকরেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা।

সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন