জুলাইয়ে সড়কে ৪৫২ দুর্ঘটনায় ৪৮৭ প্রাণহানি
১৫ আগস্ট ২০২৪ ১২:৫১
ঢাকা: গত জুলাই মাসে সারা দেশে ৪৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৮৭ জন, আহত হয়েছেন আরও ৬৭৯ জন। এর মধ্যে ১৭৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৫৬ জন, যা মোট নিহতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৯ দশমিক ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় ১১৩ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২৩ দশমিক ২০ শতাংশ।
একই সময়ে ছয়টি নৌ-দুর্ঘটনায় আটজন নিহত, ১১ জন আহত ও তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন। ১৯টি রেল ট্র্যাক দুর্ঘটনায় ১৮ জন নিহত ও ছয়জন আহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের মাসিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। ৯টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে ফাউন্ডেশনটি এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী নিহত হয়েছেন ১৫৬ জন (৩২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ), থ্রি-হুইলারের যাত্রী ১০৩ জন (২১ দশমিক ১৪ শতাংশ), ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ড ভ্যান-ট্রাক্টরের আরোহী নিহত হয়েছেন ৩৩ জন (৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ), বাসযাত্রী নিহত হয়েছেন ২৬ জন (৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ)।
এ ছাড়া প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস ও জিপের আরোহী ২০ জন (৪ দশমিক ১০ শতাংশ), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু) ১৪ জন (২ দশমিক ৮৭ শতাংশ) এবং বাইসাইকেল ও প্যাডেল রিকশার আরোহী ২১ জন (৪ দশমিক ৩১ শতাংশ) নিহত হয়েছেন জুলাই মাসে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৬১টি (৩৫ দশমিক ৬১ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১৮৯টি (৪১ দশমিক ৮১ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৬২টি (১৩ দশমিক ৭১ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে, ৩৬টি (৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ) শহরের সড়কে ও চারটি (শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।
এদিকে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে ১০৬টি (২৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ), নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯১টি (৪২ দশমিক ২৫ শতাংশ)। এ ছাড়া ১১৬টি (২৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ) দুর্ঘটনা ঘটেছে পথচারীকে চাপা বা ধাক্কা দেওয়ার, ২৬টি (৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ) দুর্ঘটনায় যানবাহনের পেছনে আঘাত করা হয়েছে এবং ১৩টি (২ দশমিক ৮৭ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, ট্রাক্টর, ট্রলি, লরি, ড্রাম ট্রাক, পুলিশ ভ্যান, ট্যাংক লরি, রোড রোলার ও ঢালাই মেশিন গাড়ি রয়েছে ২৬ শতাংশ; মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, অ্যাম্বুলেন্স ও জিপ ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ; যাত্রীবাহী বাস ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ; মোটরসাইকেল ২২ দশমিক ৭৬ শতাংশ; ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশা, অটোভ্যান, লেগুনা ও মিশুকের মতো থ্রি-হুইলার ২৩ দশমিক ৫০ শতাংশ; নসিমন, ভটভটি, আলমসাধু, টমটম ও মাহিন্দ্রার মতো স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ; বাইসাইকেল ও প্যাডেল রিকশা ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ; এবং অজ্ঞাত যানবাহন ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
গত মাসের সব দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৮০৪টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ১৮৩টি, থ্রি-হুইলার ১৮৯টি, ট্রাক ১৩৫টি, বাস ৮৬টি, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৬২টি, কাভার্ড ভ্যান ২৮টি, পিকআপ ২১টি, প্রাইভেটকার ১৮টি, বাইসাইকেল-রিকশা ২০টি।
এ ছাড়া ট্রাক্টর পাঁচটি, ট্রলি চারটি, লরি দুটি, ড্রাম ট্রাক পাঁচটি, পুলিশ ভ্যান তিনটি, ট্যাংক লরি চারটি, রোড রোলার একটি, ঢালাই মেশিন গাড়ি একটি, মাইক্রোবাস ১৭টি, অ্যাম্বুলেন্স দুটি, জিপ তিনটি এবং অজ্ঞাত ১৫টি যানবাহন দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।
বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যান
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, সবচেয়ে বেশি ২৫ দশমিক ২২ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে প্রাণহানিও সর্বোচ্চ, মোট নিহতের ২৩ দশমিক ৮১ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে চট্টগ্রাম বিভাগে— যথাক্রমে ২১ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও ২১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ দুর্ঘটনা ও তৃতীয় সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৩২ শতাংশ প্রাণহানি ঘটেছে রাজশাহী বিভাগে।
এ ছাড়া খুলনা বিভাগে ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ও ১০ দশমিক ৪৭ প্রাণহানি, বরিশাল বিভাগে ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ দুর্ঘটনা ও ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রাণহানি, সিলেট বিভাগে ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ও ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ প্রাণহানি, রংপুর বিভাগে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ দুর্ঘটনা ও ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রাণহানি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ দুর্ঘটনা ও ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রাণহানি ঘটেছে জুলাই মাসে।
সংখ্যার হিসাব বলছে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১১৪টি দুর্ঘটনায় ১১৬ জন নিহত হয়েছেন। ময়মনসিংহ বিভাগে সবচেয়ে কম ২০টি দুর্ঘটনায় ২২ জন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রাম জেলায় সবচেয়ে বেশি ৩৮টি দুর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম শরীয়তপুর, বরগুনা ও ঠাকুরগাও জেলায়— কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানি ঘটেনি। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকায় ২৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনার কারণ ও সুপারিশ
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন তাদের পর্যবেক্ষণে সড়ক দুর্ঘটনার ১০টি কারণ চিহ্নিত করেছে। পাশাপাশি সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি রোধে ১০টি সুপারিশও তুলে ধরেছে। দুর্ঘটনার যেসব কারণ উঠে এসেছে সেগুলো হলো—
- ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন;
- বেপরোয়া গতি;
- চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা;
- বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা;
- মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল;
- তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো;
- জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা;
- দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা;
- বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি; এবং
- গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি প্রতিরোধে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলো হলো—
- দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়াতে হবে;
- চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে;
- বিআরটিএর সক্ষমতা বাড়াতে হবে;
- পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে;
- মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করতে হবে;
- পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে;
- গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে;
- রেল ও নৌ পথ সংস্কার করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে;
- টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; এবং
- ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
এর আগে গত জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৪৪ জন নিহত হয়েছিলেন। সে হিসাবে জুলাই মাসে প্রাণহানি কমেছে ২৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে জুলাই মাসের বেশ কিছুদিন যানবাহন বন্ধ ছিল। মানুষ স্বাভাবিকভাবে যাতায়াত করেনি। সে কারণেই দুর্ঘটনা ও মৃত্যুহার কমেছে বলে উল্লেখ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
সারাবাংলা/টিআর