Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নেই দিকনির্দেশনা, সঠিক জায়গায় যাচ্ছে না ত্রাণ

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৬ আগস্ট ২০২৪ ২২:২৯

ফেনী থেকে: কমতে শুরু করেছে ফেনী শহরের বন্যার পানি। ফলে নগরীর প্রাণকেন্দ্র ট্রাঙ্ক রোডসহ অন্যান্য এলাকায় বেড়েছে মানুষের ব্যস্ততা। শুধুমাত্র শহরই নয়, বন্যার পানি নামছে আশপাশের কিছু এলাকা থেকেও। তবে এখনো পানিবন্দি অনেক এলাকার মানুষ। আর তাদের সাহায্যের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা। ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি এখনো উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

রোববার (২৫ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রতি মুহূর্তেই ত্রাণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন আসছেন। নগরীর বিভিন্ন স্থানে তারা ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টাও করছেন। কিন্তু এই ত্রাণ নিয়ে নগরবাসীর মাঝে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত কোনো চেইন অব কমান্ড বা স্থানীয়ভাবে কোনো সিস্টেম না থাকার কারণে ত্রাণ সঠিক জায়গায় যাচ্ছে না। অধিকাংশ ত্রাণের গাড়িতে নৌকা বা ট্রলার বা স্পিড বোট থাকলেও সেগুলো যে বর্তমানে শহর এলাকায় তেমন কাজে আসবে না, সেই বার্তাটা কেউ দিচ্ছে না। ফলে যারা আসছেন তারা যে যেভাবে পারছেন নিজেদের মতো যোগাযোগ করে ত্রাণ দিয়ে চলে যাচ্ছেন। এ কারণে একই এলাকায় একাধিক ত্রাণের গাড়ি যাচ্ছে, আবার কোনো এলাকায় তেমন কিছুই যাচ্ছে না।

আবার দেখা যাচ্ছে, শহরের বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণের একাধিক গাড়ি দেখা গেলেও গ্রামের দিকে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ফেনীর বিভিন্ন উপজেলার মানুষ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের ত্রাণের অপেক্ষায় থাকছেন।

স্থানীয়রা জানান, যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন তাদের কোনো দোষ নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে ফেনী আসার পরে অধিকাংশরাই জানতে পারছেন না কোথায় গেলে বা কী নিয়ে গেলে উপকার হবে মানুষের। অধিকাংশ দোকানপাট খুলতে শুরু করায় শহর এলাকার মানুষ অন্তত কিছু কিনে খেতে পারবে, কিন্তু যেসব এলাকা এখনো পানিতে ডুবে আছে, সেখানে নৌকা বা স্পিড বোট বা ট্রলারসহ আসা ত্রাণের ট্রাকগুলো পাঠালে বেশি উপকার হতো।

সরেজমিনে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, রোববার (২৫ আগস্ট) পানি কমা শুরু করলে ধীরে ধীরে খুলছে দোকান-পাট। শুধুমাত্র মুদি দোকানই নয়, ওষুধের দোকানের পাশাপাশি অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকানও খুলছে শহরের বিভিন্ন এলাকায়। কমবেশি সব দোকানের সামনেই দেখা গেছে ক্রেতাদের ভিড়। তবে এই সব ছাপিয়ে বর্তমানে শহরজুড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ত্রাণ পাওয়া-না পাওয়া বা সেটার প্রক্রিয়া নিয়েই।

ফেনীর প্রাণ কেন্দ্র বলে পরিচিত ট্রাঙ্ক রোডের একটি দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে অপেক্ষা করছিলেন তৌফিক হাছান নামে একজন তরুণ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি লস্করহাট। সেখানে অনেক লোক এখনো পানিবন্দি। আমি ঢাকা থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসেছি তাদের সাহায্য করতে। কিন্তু যেখান থেকে নৌকা বা ট্রলার ছাড়ার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে গিয়ে তেমন কাউকে পাইনি। অথচ শহরে দেখি এখনো অনেক এলাকায় নৌকা, ট্রলার বা স্পিড বোট নিয়ে ত্রাণ নিয়ে আসছেন। তাদের যদি শহরে প্রবেশের আগেই বলে দেওয়া যেত, এই ত্রাণগুলো নিয়ে কোন দিকে গেলে মানুষ উপকৃত হবে, তবে তারা হয়তো সেদিকেই যেত। আর তখন আরও বেশি মানুষ উপকৃত হতো।’

তিনি বলেন, ‘রাস্তায় বিশাল জ্যাম পাড়ি দিয়ে যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন তাদের দোষ দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আসলে তাদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য শহরের এন্ট্রি পয়েন্টগুলোতে যদি একটা মিডিয়া সেল বা সিস্টেম করা যেত তবে সেটা আরও ভালো হতো।’

পাশেই আরেকটা দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনছিলেন রোমান ইসলাম নামে এক তরুণ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘নৌকা বা ট্রলারগুলো এখন আসলে শহরের কোথাও নামানো সম্ভব নয়। কারণ, সেই পরিমাণ পানি এখন আর নেই। যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন তাদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার তেমন কেউ নেই। কারণ, কেউ তো আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছেন না।’

তিনি বলেন, ‘আমার বাসা দুই তলা হলেও নিচতলার প্রায় ১০ থেকে ১২ ফুট পানিতে ডুবে ছিল। তাই বের হওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু আজ তা কমে যাওয়ায় বের হয়েছি। ছয়টা দুই লিটারের পানির বোতল কিনলাম ২৪০ টাকা দিয়ে। তার মানে দাম কিন্তু বেশি না। অর্থাৎ শহরের যারা একটু অবস্থা সম্পন্ন তারা কিন্তু চাইলে জিনিসপত্র কিনতে পারবে। তবে সবার পক্ষে সেটা সম্ভব নাও হতে পারে। আর তাই ত্রাণ একদম মানাও করা যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু একটা সিস্টেম গড়ে তোলা না গেলে ত্রাণ সমমাত্রায় সবখানে বিতরণ করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকলেও হয়তোবা মানুষকে জানানো সম্ভব হতো কোন কোন এলাকায় ত্রাণ প্রয়োজন। কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।’

স্থানীয়রা জানান, পানি নেমে যাওয়ার পরে মূলত ফেনীর অধিকাংশ শহরের মানুষদের বর্তমান সমস্যা হলো বিশুদ্ধ পানির সংকট। ত্রাণ হিসেবে কিছু পানি পাওয়া গেলেও সেটা অপ্রতুল বলেই অভিযোগ তাদের। আবার কেউ কেউ জানালেন তারা এখন পর্যন্ত ত্রাণই পাননি। তবে এ সময় তাদের মাঝেই দেখা যায় ত্রাণ পাওয়ার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে একাধিক বক্তব্য।

ত্রাণ বিতরণ করতে আসা একাধিক সংগঠনের কর্মীরা জানান, তারা যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই ত্রাণ না পাওয়া অভিযোগ জানতে পারছেন। এমনকি যেখানে তারা ত্রাণ দিয়ে আসছেন সেখান থেকেও আবার একই রকমের অভিযোগ আসছে।

মীর রাশেদুল ইসলাম নামের এক স্বেচ্ছাসেবক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সিলেট থেকে দুই দিনে তিনটা পিকআপে এসেছি ত্রাণ নিয়ে। পানির বোতলসহ নানা ধরনের শুকনো খাবার প্যাকিং করে এনেছি আমরা। আমাদের ইচ্ছে ছিল তিনটা এলাকায় দেওয়ার। কিন্তু মহীপালের একটু আগে কয়েকজন জানান, তাদের এলাকায় কোনো ত্রাণ দেওয়া হয়নি। তাই আমরা যেন সেদিকে যাই। তখন আমরা প্রথম পিকআপটি নিয়ে মানুষের হাতে ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করি। কিন্তু পরের গাড়ি যখন আসে তাদেরকেও বলা হয়, তারা নাকি কোনো ত্রাণই পাননি। আসলে বিষয়টা আমরা বুঝতে পারছি না।’

তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে আসলে একটা সেন্টার পয়েন্ট থাকলে ভালো হতো। যেহেতু আমরা চিনি না, তাই আমাদের সেই পয়েন্ট থেকে কোনো এলাকায় যেতে হবে, সেই নির্দেশনাটা দেওয়া হলে আরও বেশি সন্তুষ্ট হতাম।’

ত্রাণের গাড়ির সঙ্গে নৌকা এনে বিপাকে পড়া একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের হতাশার কথা জানা যায়। তারা বলেন, যখন ট্রলার ভাড়া করে ট্রাকে তুলি তখন কিন্তু অনেক পানি ছিল ফেনীর বিভিন্ন এলাকায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সবাই ট্রলার সংকটের কথা বলছিল। কিন্তু ট্রলার ভাড়া করে আনলেও শহরে যেখানে ত্রাণ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, সেখানে পৌঁছানোর মতো পানি ছিল না।

ট্রাঙ্ক রোড এলাকায় রশিদুল ইসলাম নামে একজন স্থানীয় নাগরিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসলে যারা আসছে তাদের তো কোনো দোষ নাই। বরং তাদের সবাইকে আমাদের সম্মান জানানো প্রয়োজন। তারা তো আমাদের বিপদে পাশে দাঁড়াতেই এসেছে। কিন্তু একটা দুর্যোগে নানা রকমের মানুষ থাকে। এখন এক দুইটা খারাপ ব্যক্তির কারণে যদি তারা কেউ তিক্ত মনে বাড়ি যায় তবে সেটা আমাদের জন্যও খারাপ।’

তিনি বলেন, ‘এখন আসলে এলাকাভিত্তিক কিছু কমিটি করে, ত্রাণ কাদের প্রয়োজন সেটার একটা তালিকা করা দরকার। যদি সবার প্রয়োজন হয় তবে সবাইকেই দেওয়া হোক। কিন্তু সেটা তালিকা অনুযায়ী করলে যারা দিতে আসছেন তাদেরও অনেক সুবিধা হবে। আবার সব খানে সবাই সমানভাবে ত্রাণও পাবেন।’

জহিরুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক তরুণ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখনো ফেনী শহরের বাইরের অনেক এলাকায় কিন্তু পানি জমে আছে। সেখানে মানুষের প্রচুর পরিমাণে সাহায্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র ত্রাণই না, অনেককে উদ্ধার করাও প্রয়োজন। এমন অবস্থায় আসলে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হলে একটা উপকার হতো।’

প্রশাসন যা বলছে

ফেনী জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ভয়াবহ বন্যার কারণে সীমান্তবর্তী ছয় উপজেলাসহ ফেনীর অন্তত আট লাখ মানুষ ক্ষ‌তিগ্রস্ত হ‌য়ে‌ছে। জেলা প্রশাসক মোসাম্মাৎ শা‌হিনা আক্তার জানান, ইতোমধ্যে জেলার বন‌্যাকব‌লিত অন্তত দেড় লাখ মানুষ‌কে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হ‌য়ে‌ছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে অনেকে বা‌ড়ি ও আশপাশে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় পর্যাপ্ত ত্রাণও বিতরণ হচ্ছে বলে দাবি তার।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘কেবল সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার দি‌য়ে ৩৮ হাজার মানুষের কাছে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছা‌নো হ‌য়ে‌ছে।’

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

কার্যক্রম ত্রাণ ফেনী


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর