তলিয়ে গেছে ক্ষেত, ভেসে গেছে ঘের— নড়াইলের মৎস্য-কৃষিতে শত কোটির ক্ষত
১৫ অক্টোবর ২০২৪ ১০:০১
নড়াইল: সারা দেশের মতো এ বছরের বর্ষা মৌসুমে দফায় দফায় ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হয়েছে নড়াইলেও। বেশ কয়েকবারের টানা প্রবল বর্ষণে তলিয়ে গেছে জেলার সাড়ে তিন হাজার ঘের ও পুকুর। পানিতে ডুবে গেছে সবজিসহ অন্যান্য ফসলের জমিও। মৎস্য ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি জেলার হাজারও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে।
জেলার কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, জেলার কৃষকদের অন্তত ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর মৎস্য বিভাগ বলছে, মৎস্য ব্যবসায়ীদের ক্ষতি অন্তত ৯০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে কৃষিনির্ভর এই জেলায় এবারের বর্ষা মৌসুম শত কোটি টাকার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিল ও ঘের বেষ্টিত প্রায় আট লাখ বাসিন্দার জেলা নড়াইল। জেলার অধিবাসীদের জীবিকার প্রধান উৎস কৃষি ও মৎস্য খাত। এ জনপদের ৮২ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ধান, পাট, গমসহ বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি এ জেলার অন্তত ৫০ হাজার মানুষ মৎস্য চাষের সঙ্গে সরাসরিভাবে জড়িত।
নড়াইল শহরের ঘের ব্যবসায়ী কৃষক মো. আহাদউজ্জামান এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মৎস্য চাষে যুক্ত। নড়াইল পৌর এলাকার ভওয়াখালী বিলে তিনটি ঘের রয়েছে তার। বিভিন্ন জায়গা থেকে ধারদেনা করে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে এ বছরও বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ শুরু করেছিলেন। টানা বৃষ্টিতে তার তিনটি ঘের তলিয়ে গেছে, নষ্ট হয়েছে ঘেরের পাড়ের বিভিন্ন সবজি। পানিতে টইটুম্বর ঘের আর বিল মিলেমিশে একাকার।
আহাদউজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধারকর্জ করে ছয় লাখ টাকা খরচ করেছি। আশা ছিল, অন্তত ১০ লাখ টাকা আয় হবে মাছ-সবজিতে। সেই স্বপ্ন বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে। ঘেরের মাছ সব বিলে চলে গেছে। পাড়ের ক্ষেতের সব সবজি পচে গেছে। সমিতির ঋণ আর মাছের খাবারের দোকানের বাকি টাকা কীভাবে শোধ করব, সেই চিন্তায় ঘুম নেই।’
স্থানীয় কৃষক ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, জেলার বিল ও ঘের অঞ্চলের সব মৎস্য ব্যবসায়ী ও কৃষকদের অবস্থাও একই। তিন দফার টানা প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটসহ ঘের-পুকুর-ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় নড়াইল সদর, লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলার হাজারও মৎস্য ব্যবসায়ী ও কৃষকের এখন পথে বসার দশা। এর মধ্যে বেশি ক্ষতির শিকার নড়াইল সদর ও কালিয়া উপজেলার প্রান্তিক চাষিরা।
পৌর এলাকার দুর্গাপুর গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী জিরু শেখ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে ঘের ব্যবসা করি। বৃষ্টিতে এত ক্ষতি কখনো হয়নি। সাড়ে তিন একর জমিতে দুটি ঘেরে যত মাছ ছিল, সব চলে গেছে।’ অন্তত সাত লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবী তার।
একই এলাকার আরেক ব্যবসায়ী আজিজুর শেখের পাঁচটি ঘেরের মধ্যে চারটি ঘেরের মাছ চলে গেছে। ঘেরের পাড়ের সব সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। এতে আট লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
কৃষক খাজা মিয়া বলেন, ‘বিল আর ঘের আলাদা করার উপায় নেই। সব পানিতে তলিয়ে গেছে।’ আড়পাড়া গ্রামের কৃষক তজিবর শেখের অভিযোগ, ‘যেসব জমিতে পায়ে হেঁটে যেতাম সেই জমিতে নৌকা ছাড়া যেতে পারছি না। জমিতে কোনো ফসল অবশিষ্ট নেই, সব নষ্ট হয়ে গেছে।’
জেলার মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এক হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে মোট ঘের রয়েছে পাঁচ হাজার ৩০০টি। বৃষ্টির পানিতে এর দুই-তৃতীয়াংশ, অন্তত সাড়ে তিন হাজার ঘের ও পুকুর তলিয়ে গেছে। এ জনপদে ঘের ব্যবসায়ীর সংখ্যা সাড়ে ১০ হাজার। সব মিলিয়ে মাছ চাষে নিয়োজিত প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। এর মধ্যে অন্তত ৩৩ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর্থিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৯০ কোটি টাকা।
এদিকে কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, আমন ধান, ঘেরের পাড়ে শিম, মিষ্টিকুমড়া, শশা, পেঁপেসহ বিভিন্ন জাতের সবজি তলিয়ে যাওয়ায় জেলায় কৃষি খাতে ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রবল বর্ষণে এ জনপদে ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকা।
কৃষক বা মৎস্য চাষি ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতির এই প্রভাব কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কৃষি ও মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নড়াইল খাদ্য ও মাছে উদ্বৃত্ত জেলা। জেলায় বছরে ১৬ হাজার মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে মাছ উৎপাদন হয় ১৮ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অন্তত দুই হাজার মেট্রিক টন মাছ উদ্বৃত্ত থাকে এ জেলায়। আবার প্রতি বছর চাহিদা মিটিয়ে অন্তত এক লাখ মেট্রিক টন শস্য-সবজিও উদ্বৃত্ত থাকে এ জনপদে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবল বর্ষণের প্রভাবে মাছ ও ফসলের ক্ষতিতে সামনের বছরে জেলার চাহিদা পূরণেই নির্ভর করতে হবে অন্য এলাকার ওপর। ফলে অতি বৃষ্টির এই প্রভাব জেলার খাদ্য নিরাপত্তাকেও হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। কৃষি ও মৎস্য বিভাগ অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের সহায়তার আশ্বাস দিচ্ছে।
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আশেক পারভেজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সরকারিভাবে বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করা হবে। আশা করছি, এতে কিছুটা হলেও তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে।’
নড়াইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এইচ এম বদরুজ্জামানও জানালেন একই কথা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত ঘের ব্যাবসায়ীদের তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে মৎস্য ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করা হবে। বরাদ্দ না পেলে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার কোনো সুযোগ নেই। ব্যবসায়ীরা যেন আগামীতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে জন্য মাঠপর্যায়ে তাদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন মাঠ কর্মীরা।’
সারাবাংলা/এসডব্লিউআর/টিআর