Wednesday 04 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সেন্টমার্টিন নিয়ে সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী— বলছেন পর্যটনসংশ্লিষ্টরা

ওমর ফারুক হিরু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৩১ অক্টোবর ২০২৪ ১২:০৫

ড্রোনের চোখে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। সারাবাংলা ফাইল ছবি

কক্সবাজার: দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চলতি মৌসুমের নভেম্বর মাস থেকেই পর্যটক যাতায়াত সীমিত করা এবং রাত্রিযাপনে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। কেবল কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিন নয়, এ সিদ্ধান্ত ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছে গোটা দেশের পর্যটন খাতেই।

পর্যটন খাতের সংশ্লিষ্টরা খুব স্পষ্ট ভাষায় সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ‘আত্মঘাতী’ বলে অভিহিত করেছেন। তারা বলছেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে কক্সবাজারে পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বিনিয়োগকারীসহ পর্যটন খাতের প্রত্যেকেই। সরকার সহযোগিতা করলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পর্যটন অব্যাহত রেখেও সেন্টমার্টিনের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করা সম্ভব।

বিজ্ঞাপন

সরকারের সিদ্ধান্তে শঙ্কা ঘিরে ধরেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীকেও। তারা বলছেন, তাদের জীবন-জীবিকা এখন অনেকটাই আবর্তিত হয় পর্যটন খাত ঘিরে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেন্টমার্টিনে পর্যটন সারা বছরই প্রায় বন্ধ থাকলে তারা জীবন চালিয়ে নিতেই দুর্ভোগে পড়বেন।

দেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজার থেকে জাহাজপথে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থান সেন্টমার্টিন দ্বীপের। পর্যটন গন্তব্য হিসেবেও দেশের একমাত্র এই প্রবাল দ্বীপের অবস্থান সবসময়ই শীর্ষে। ভরা মৌসুমে রাতে পর্যটকদের থাকার জায়গা পর্যন্ত দিতে মুশকিলে পড়তে হয় হোটেল-মোটেলগুলোকে। দীর্ঘ দিন ধরেই এই দ্বীপের পর্যটন সীমিত করা নিয়ে আলোচনা ছিল বিভিন্ন মহলে। একাধিকবার দ্বীপটিতে রাতে পর্যটকদের থাকার সুযোগ বন্ধ করা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো রাজনৈতিক সরকারই এমন কেনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

বিজ্ঞাপন

শেষ পর্যন্ত দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গত ২২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ এক বৈঠকে সেন্টমার্টিন নিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। বলা হয়, পরিবেশবান্ধব রাখতে ১ নভেম্বর থেকেই এই দ্বীপে পর্যটকদের যাতায়াত সীমিত করা হবে। এ মাসে পর্যটকরা সেন্টমার্টিনে যেতে পারলে রাতে থাকতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে প্রতিদিন মাত্র দুই হাজার পর্যটক দ্বীপটিতে রাতে থাকতে পারবেন। ফেব্রুয়ারি মাসে পর্যটকদের যাতায়াত সম্পূর্ণভাবেই বন্ধ থাকবে।

সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা বলেছেন, একসময় সাগরের মাছ শিকারই ছিল তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা জনসংখ্যায় যেমন বেড়েছেন, তেমনি সেন্টমার্টিনেরও রূপান্তর হয়েছে শীর্ষ পর্যটন গন্তব্য হিসেবে। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় তাদের জীবিকাও পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। এখন হুট করে পর্যটন ব্যাপক হারে সীমিত হয়ে পড়লে তাদের জীবিকায় টান পড়বে। অনেককে রীতিমতো পথেই বসতে হবে।

ড্রোনের চোখে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। সারাবাংলা ফাইল ছবি

সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা মোবারক আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাপ-দাদারা এই দ্বীপে মাছ শিকার করে জীবন চালাত। এই সুন্দর দ্বীপটি যখন থেকে পর্যটকদের আকর্ষণের জায়গায় পরিণত হয়েছে তখন থেকে এখানকার মানুষের জীবনমানও বদলে যেতে থাকে পর্যটকদের সেবা দেওয়ার মাধ্যমে। এমনিতেই বর্ষা মৌসুমসহ বছরের অর্ধেক সময় এই দ্বীপে পর্যটকের আনাগোনা কম। এখন ভরা মৌসুমেও পর্যটকদের যাতায়াত সীমিত করলে আমরা কোথায় যাব? আমাদের কথা কি কেউ ভাববে না?’

আরেক বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরাও চাই এই দ্বীপ রক্ষা পাক। তার অর্থ এই নয় যে এখানে পর্যটক আসবে না। পর্যটকের কারণে নয়, অবৈধ স্থাপনা গড়ে প্রভাবশালীরাই এই দ্বীপের ক্ষতি করছে। ব্যবস্থা নিলে তাদের বিরুদ্ধে নিতে হবে। তা না করে পর্যটক সীমিত করলে দ্বীপবাসী অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এই দ্বীপের বেশির ভাগ মানুষ অপেক্ষায় থাকেন, কখন পর্যটক আসবে আর তাদের সেবা দিয়ে কিছু উপার্জন করা যাবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দ্বীপবাসীর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিরও ক্ষতি হবে।’

সরকারের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন পর্যটন খাতের সংশ্লিষ্টরা। মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) রাজধানীতে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধনে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পরিবেশ ও পর্যটন রক্ষা উন্নয়ন জোট সরকারকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে দুই দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে। জোট নেতারা বলেছেন, পর্যটন চালু রেখেই সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশসহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে।

একই স্থানে সোমবার (২৮ অক্টোবর) আয়োজিত এক মানববন্ধনে ট্যুর অপারেটররা এই বিধিনিষেধ পর্যটন শিল্পের জন্য অপরিণত সিদ্ধান্ত বলে দাবি করেন। বলেন, এ সিদ্ধান্তকে দেশের পর্যটনের জন্য ধ্বংসাত্মক হবে।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) পর্যটন শিল্পের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে সরকারকে এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটি বলছে, এ সিদ্ধান্তে পর্যটন শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এই খাতের উদ্যোক্তারা সর্বস্বান্ত হয়ে যাবেন। বেকার হয়ে যাবেন সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারাও।

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. আল আমিন বিশ্বাস তুষার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘুরতে আসা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। সরকারের এ সিদ্ধান্তে পর্যটকরা কক্সবাজার বিমুখ হয়ে পড়বেন। এতে চলতি মৌসুমে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পর্যটক কমে যাওয়ার পাশাপাশি ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। আর চরম দুর্ভোগে পড়বেন পর্যটনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত তিন লাখের বেশি মানুষ।’

পর্যটন অব্যাহত রেখেও কীভাবে সেন্টমার্টিনকে সুরক্ষিত রাখা যায়, সেদিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানালেন কক্সবাজার সি ক্রুজ অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর।

তিনি বলেন, ‘পর্যটন মৌসুমে শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে সরকারের এ সিদ্ধান্তে কক্সবাজারের পুরো পর্যটন খাতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এ সিদ্ধান্ত পর্যটনের শিল্পের জন্য আত্মঘাতী। পর্যটক যাতায়তে নিষেধাজ্ঞা নয়, সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে দ্বীপের পরিবেশ ও প্রতিবেশ কীভাবে রক্ষা করা যায়, তার আলোকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’ সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জেরে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে যাত্রীবাহী নৌ যানসহ পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার পর্যটকদের যাতায়তের বিকল্প রুট উখিয়ার ইনানী সৈকতের নৌ বাহিনীর জেটিটিও ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে উত্তাল হয়ে ওঠা সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়।

ওই রুটে চলাচলকারী জাহাজ কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১ নভেম্বরের আগেই জেটিটির ক্ষতিগ্রস্ত অংশটির সংস্কারকাজ শেষ করা হবে। এতে পর্যটকদের দ্বীপে যাতায়তে কোনো অসুবিধা হবে না।

সারাবাংলা/টিআর

পর্যটন পর্যটন খাত পর্যটন শিল্প সেন্টমার্টিন সেন্টমার্টিনে পর্যটন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর