জাপা কার্যালয়ে হামলায় উদ্বেগ, রাজনৈতিক চর্চায় সহিষ্ণুতার আহ্বান
৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:২৫
ঢাকা: ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের তিন মাসের মাথায় এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তোপের মুখে পড়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ফেসবুক স্ট্যাটাস ও বক্তব্যে দলটিকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ডেকেও পরে পুলিশের নিষেধাজ্ঞার মুখে সেই সমাবেশ করতে পারেনি দলটি।
কেবল কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়, খুলনা জেলা ও মহানগরসহ আরও বেশকিছু এলাকায় জাপা কার্যালয়ে হামলা-আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় রাজনীতিতে রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি।
বাম ও ডানপন্থি রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, জাতীয় পার্টির জন্ম সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে। গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের ‘দাক্ষিণ্যে’র ওপর ভর করে রাজনীতি টিকিয়ে রেখেছিল দলটি। এর আগে তাদের শাসনামলেও রাজনৈতিক দলসহ জনগণকে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য ভুগতে হয়েছে। তারপরও একটি গণআন্দোলনের পর সবাইকে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় যুক্ত করতে হলে গণতান্ত্রিক আচরণ করতে। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর হামলা-নির্যাতন কেবল গণতন্ত্রের যাত্রাকে কঠিন করে তুলবে।
শনিবার (২ নভেম্বর) রাজধানীর কাকরাইলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ঘোষণা করেছিল জাতীয় পার্টি। সমাবেশ সামনে রেখে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় কার্যালয়েই সভা চলাকালে ছাত্র-জনতা হামলা চালায়। ‘স্বৈরাচারের দোসর’ অভিহিত করে দলটির কার্যালয়ে আগুন পর্যন্ত দেওয়া হয়। পরে ঢাকা মহানগর পুলিশ শনিবার ওই এলাকায় সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় আর সমাবেশ করেনি জাপা। ওই দিন আবার খুলনায় জাপা কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার জাপা কার্যালয়ের সামনে প্রথম দফায় ‘ছাত্র-জনতা’র সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ‘জাপাকে নিশ্চিহ্ন’ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। পরে আরেক স্ট্যাটাসে হাসনাত ও আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম লিখেছিলেন, ‘যে পথে গেছে আপা, সেই পথেই যাবে জাপা’। ছাত্রনেতাদের এমন তীব্র বিরোধী অবস্থানের মুখে জাতীয় পার্টির দলীয় কর্মসূচি পালন করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে এভাবে হামলা ও দলটির বিরুদ্ধে হুমকির সমালোচনা করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, এর মধ্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চলছে। রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার আমরা কারা? জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে কে নিষিদ্ধ হবে আর কে রাজনীতি করবে।’
জাপার ওপর হামলাকে ‘মব জাস্টিস’ আখ্যা দিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম। এ ধরনের আচরণের সমালোচনা করে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দোসর, এতে ভুল নেই। কিন্তু পার্টি অফিসে অগ্নিসংযোগ করে বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দলটিকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। বরং তাদের প্রতি জনগণের সহানুভূতি বাড়বে।’
‘মব জাস্টিস’ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে সিপিবি সভাপতি বলেন, ‘রাজনীতি করার অধিকার সংবিধান দিয়েছে। কেউ অপরাধ করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার হবে। কিন্তু মব জাস্টিস করার অধিকার কারও নেই। অবিলম্বে এগুলো বন্ধ করা উচিত। তা না হলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল নষ্ট হবে।’
হামলা-নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে অবস্থান জানালেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকও। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হয় রাজনৈতিকভাবে। নির্বাহী আদেশে দল বা সংগঠন নিষিদ্ধ করা কিংবা হামলা করে কোনো দলের রাজনীতি বন্ধ করা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য ভালো উদাহরণ নয়। জনগণ নির্ধারণ করবে কে রাজনীতি করবে। কোনো দলকে যদি পছন্দ না হয়, তাহলেও তার রাজনীতি করার অধিকার মেনে নিতে হবে। এটিই গণতন্ত্রের শিক্ষা।’
সাইফুল হক আরও বলেন, ‘কোনো দল অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকলে আদালতের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে হবে। পার্টি অফিসে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর গ্রহণযোগ্য নয়। একটি অভ্যুত্থানের পরে সরকার যখন সবাইকে গণতান্ত্রের অভিযাত্রায় যুক্ত করতে চাইছে, তখন সবার আচরণও গণতান্ত্রিক হতে হবে।’ অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর-মব জাস্টিসে অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে সরকারও ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি।
জাতীয় পার্টি দলটি আওয়ামী লীগের দোসর ছিল মন্তব্য করে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির জন্ম সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে। তাদের নির্যাতনের কথা আমাদের মনে আছে। এই জাতীয় পার্টি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারেরও দোসর। একতরফা নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা সরকারকে সহযোগিতা করেছে।’
তবে তা সত্ত্বেও রাজনীতির মাধ্যমেই দলটিকে বিলুপ্ত করে দিতে হবে বলে মনে করেন বজলুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টির যেসব নেতারা মন্ত্রী ছিলেন, দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করে কোনো দলতে ধ্বংস করা যায় না। যেমন— গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমেই মুসলিম লীগ আজ বিলুপ্ত। একইভাবে জাতীয় পার্টিকেও বিলুপ্ত করা যায়।’
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল্লাহ কায়সার, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি, রব) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন স্বপনও রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও মব জাস্টিসের বিপক্ষে অবস্থান জানিয়েছেন। তারা বরং জাতীয় পার্টিকে আদালতের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনার পক্ষে অভিমত দেন।
একই কথা বলেছেন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক হাফেজ মাওলানা ইউনুসও। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আগুন দেওয়া, ভাঙচুর, গায়েবি মামলা— এগুলো অন্যায়। কেউ অপরাধ করলে প্রচলিত আইনের মাধ্যমেই যথাযথ বিচার করা উচিত। শুধু জাতীয় পার্টি কেন, যেকোনো দল বা সংগঠনের অফিসে হামলা-ভাঙচুরই অপরাধ। সচেতন সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থা এগুলো মেনে নিতে পারে না।’ অন্যায়-অপরাধ দমন করে সমাজে স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে জাতীয় পার্টির কোনো কোনো নেতাকর্মী বৃহস্পতিবারের হামলার জন্য সাবেক ডাকষু ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদকে দায়ী করেছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান সে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পাশাপাশি জাতীয় পার্টিকে সমর্থন দেওয়াকেও ফ্যাসিস্টের পক্ষে থাকার সঙ্গে তুলনা করেন তিনি।
রাশেদ খান সারাবংলাকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর জাতীয় পার্টির অতীত অপরাধের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। গত ১৫-১৬ বছর ধরে দেশের মধ্যে অরাজকতা-দলীয়করণ, গুম-হত্যা-গায়েবি মামলাসহ যত ধরনের অন্যায় করেছে আওয়ামী লীগ সরকার, তার সহযোগী ছিল এই দল। জনগণ তাদের বিচার করবে, এটাই স্বাভাবিক।
রাশেদ আরও বলেন, ‘জিএম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তারা কীভাবে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করেন? এতে করে আমাদের বা জনগণের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, তারা সরকারের সহায়তা নিয়েছে কি না। এই মুহূর্তে গণতন্ত্রের বুলি আউড়ে যারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের পক্ষে কথা বলছেন, আমরা মনে করি তারা ফ্যাসিস্টদের পক্ষই নিচ্ছেন।’
আরও পড়ুন-
- জাতীয় পার্টির বিক্ষোভ
- জাপার সমাবেশ-বিক্ষোভ স্থগিত
- জাপার সঙ্গে ‘ছাত্র-জনতা’র সংঘর্ষ
- জাপা অফিসে লুটপাটের অভিযোগ
- জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন
- ‘মরতে হয় মরে যাব, সমাবেশ আমরা করবই’
- কাকরাইল এলাকায় শনিবার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ
- খুলনায় জাতীয় পার্টি কার্যালয় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
- সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হামলা কি না— প্রশ্ন জাপা নেতার
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
গণতান্ত্রিক চর্চা জাতীয় পার্টি জাপা জাপা কেন্দ্রীয় কার্যালয় পার্টি অফিসে আগুন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন