‘আমি এসি রুমে বসে থাকার লোক নই’
৫ নভেম্বর ২০২৪ ২০:০৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: আমি এসি (শীততাপ নিয়ন্ত্রিত) রুমে বসে থাকার লোক নই, স্পটে যাব, গিয়ে যদি কাউকে না পাই চাকরি থাকবে না— দায়িত্ব গ্রহণের আগমুহুর্তে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে অকপটে এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) বিকেলে নগরীর লালদিঘীর পাড়ে চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের সম্মেলন কক্ষে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের পর মেয়র সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এরপর তিনি নগরীর টাইগারপাসে চসিকের অস্থায়ী কার্যালয়ে যান। সেখানে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার পর তিনি মেয়রের দায়িত্ব নেন।
রোববার (৩ নভেম্বর) ঢাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফের কাছে মেয়র হিসেবে শপথ নেন আদালতের রায়ে এ পদে আসা বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন। একদিন পর মঙ্গলবার দুপুরে তিনি ট্রেনে চট্টগ্রামে পৌঁছান। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে হাজারো নেতাকর্মী মেয়রকে শুভেচ্ছা জানান। এরপর নগরীর জেল রোডে আমানত শাহ ও বদর শাহ’র মাজার জিয়ারত শেষে মেয়র শাহাদাত হোসেন লালদিঘীর পাড়ে চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে যান।
‘চট্টগ্রাম নিয়ে ভাবতে হবে সারাদেশকে’
কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের শুরুতে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এমন একটি সময়ে আমি দায়িত্বভার নিয়েছি যখন দেশ একটি ক্রান্তিকাল পার করছে, একটা ক্রাইসিস মোমেন্টের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই যাচ্ছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে, আমাদের মা-বোনেরা ইজ্জত দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা এপথে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রামের প্রথম শহিদ ওয়াসিম, আবু সাঈদ কিংবা মুগ্ধের মতো হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েও আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। আমরা বারবার গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার পথে বাধাগ্রস্ত হয়েছি।’
আইন লড়াইয়ের মাধ্যমে মেয়র পদে এসেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সাড়ে তিন বছর আগে যে নির্বাচনটা হয়েছিল ইভিএমের মাধ্যমে, কিন্তু আমাকে ফলাফল দেয়া হয়েছিল হাতে লিখে। যেখানে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ১০০ ভোট পেয়েছেন, সেটাকে ৩০০ বানিয়ে হাতে লেখা একটা ফলাফল দিয়ে আমাকে পরাজিত দেখানো হয়েছিল। তখন আমি আদালতের কাছে গিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, আমাকে ইভিএমের প্রিন্টেড কপি দেন, আমি গ্রহণ করবো, আমি হাতে লেখা কপি গ্রহণ করবো না। আমি আইনের পথে গিয়েছিলাম, রায় পেয়েছি এবং আজ আপনাদের সামনে আসতে পেরেছি।’
চট্টগ্রামের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মেয়র বলেন, ‘চট্টগ্রাম ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমন এক জায়গায় আছে, চট্টগ্রাম নিয়ে ভাবার জায়গা শুধু চট্টগ্রাম নয়। এ চিন্তা হতে হবে সারাদেশের ও কেন্দ্রীয় সরকারের। চট্টগ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে- এ স্লোগান দিয়ে আমি কাজ শুরু করবো। চট্টগ্রাম শুধু আমার একার নয়, চট্টগ্রাম সারাদেশের- এ স্লোগান দিয়ে কাজ শুরু করবো। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি, হেলথি সিটি- এটা আমার নির্বাচনী ইশতেহার।’
‘সমস্ত চ্যালেঞ্জ আমি নিলাম’
মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘চসিকের অর্গানোগ্রামে তিন থেকে চার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারি থাকার কথা, সেখানে হয়ে গেছে নয় হাজারের মতো। আমি যখন দায়িত্ব নিচ্ছি, তখন প্রায় ৪৪০ কোটি টাকার ঘাটতি, ঋণের বোঝা আমাকে নিতে হচ্ছে। আমি অনেক চ্যালেঞ্জ এর আগেও মোকাবেলা করেছি। আমি ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রেডক্রিসেন্টের দায়িত্ব পালন করেছি। আমি যখন বিদায় নিই, তখন আমি সাড়ে চার কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট রেখে আসি। একটি নতুন ভবনও আমি তৈরি করেছিলাম।’
কর্মকর্তা-কর্মচারিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের আশা দিতে চাই, আপনারা অত্যন্ত সততার সাথে, দুর্নীতিমুক্ত হয়ে, আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে কাজ করবেন আমার সাথে। আপনাদের সমস্ত চ্যালেঞ্জ আমি নিলাম। চসিককে আমি স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে আপনাদের উপহার দেব ইনশল্লাহ। সততা থাকতে হবে। কাজের প্রতি মমত্ববোধ থাকতে হবে। নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে।’
চসিক পরিচালনায় নগরবিদ, পেশাজীবীরা, সাবেক মেয়র এবং বুদ্ধিজীবীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের পরামর্শ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
‘আমি এসি রুমে বসে থাকার লোক নই’
দায়িত্ব নিয়েই নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে যাবেন জানিয়ে মেয়র বলেন, ‘আমি এসি রুমে বসে থাকার লোক নই। অত্যন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে ৪১ ওয়ার্ডে আমি কর্মসূচি দেব। আমাদের প্রধান সমস্যা, ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিটি ওয়ার্ডে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য লিফলেট বিলি করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগকে বলবো, আমরা একটা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট রেসপন্স সেন্টার করতে চাই। একটা হটলাইন থাকবে। আক্রান্তরা সেখানে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নেবেন। ৪১টা ওয়ার্ডের মধ্যে প্রতিটি ওয়ার্ডে সচিবদের উদ্যোগে একটি ডেঙ্গু হেল্প ম্যানেজমেন্ট সেন্টার থাকবে। সেখানেও আক্রান্তরা সাহায্য পাবেন। এখন ইর্মাজেন্সি হচ্ছে ডেঙ্গু, সেটা মোকাবেলায় আমাদের যা যা করা দরকার, সব করবো।’
মেয়র আরও বলেন, ‘লার্ভিসাইড কিলিং করার যে স্প্রে, সেটার কোয়ালিটি আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই। এমন কোনো স্প্রে চাই না, যেটা দিলে মশা মরবে না, বরং আরও বাড়বে। মশা মরছে কি না অবশ্যই সেটা দেখতে হবে। মশা না মরলে এ ধরনের স্প্রে আমি গ্রহণ করবো না। আমি নিজেই স্পটে যাব। এখানে (অফিসে) সকালে আমি আধাঘণ্টা-একঘণ্টা থাকবো, তারপর আমি বেরিয়ে যাবো। আমার সঙ্গে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানের কর্মীরা থাকবেন, ডেঙ্গু নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা থাকবেন। আমি দুই-তিন ঘণ্টা বিভিন্ন ওয়ার্ডে থাকবো।’
শাহাদাত বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতা বিভাগে দুই হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারি কাজ করছেন, আমি জানতে পেরেছি। আমি প্রতিটা ওয়ার্ডে গিয়ে সশরীরে তাদের দেখতে চাই। যদি ওয়ার্ডে গিয়ে কাউকে না পাই, দুঃখের সঙ্গে বলছি, তাদের হয়তো চাকরিটা থাকবে না। আমাকে অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। বারবার বলছি, আমি এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্বে এসেছি।’
‘আমার রাজনীতি সিটি করপোরেশনের বাইরে’
নগর ভবনকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করে মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ, আমার রাজনীতি সিটি করপোরেশনের বাইরে। আমি আমার সমস্ত নেতাকর্মীদের বলছি, আপনারা আমাকে কাজের সময় ডিস্টার্ব করবেন না। আমি আপনাদের সঙ্গে রাজনীতি করবো বিকেল পাঁচটার পরে। কিন্তু সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কোনো ধরনের রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা নিয়ে আমার এখানে আসবেন না।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় দেখেছি, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা রাত দশটা পর্যন্ত অফিস করেন। ৮৫ বছরের বয়স্ক একজন লোক দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। এত বয়সী একজন লোক যদি এত কষ্ট করতে পারেন, তাহলে আমরা কম বয়সীরা পারবো না কেন। কাজের প্রতি সততা ও সিনসিয়ারিটি থাকতে হবে।’
‘দোকানের সামনে ময়লা থাকলে ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হবে’
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কাজের ওপর সর্বোচ্চ জোর দেবেন উল্লেখ করে মেয়র বলেন, ‘আমি ক্লিন সিটি গড়ার কথা বলেছি। নগরীর বাসিন্দাদের বলবো, আপনার বাড়ির উঠোন পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব আপনার। বাকিটা আমার দায়িত্ব। যেসব দোকানপাট আছে, দোকানের সামনে আপনারা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন। দোকানের সামনে ময়লা পড়ে থাকলে নিজেই ওঠাবেন, না হলে আইনি পথে যাবো। ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হয়ে যেতে পারে।’
‘আমি রাজনীতি করে বড় হয়েছি। ভয়ভীতি, ধমক কেউ দিলে বোকার স্বর্গে বাস করবেন। প্লিজ, দেশকে ভালোবাসুন। দেশের প্রতি মমত্ববোধ, দেশের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে নতুন প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য দেশ আমরা গড়তে পারবো না। বাঙালিরা কর্মঠ। আমরা কাজ করতে জানি। কিন্তু আমরা একটা সিস্টেমের মধ্যে আটকে গেছি।’
সবাইকে আইন মানতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে আইন আছে, আইনের প্রয়োগ নেই। আইনের প্রয়োগটা আমাদের করতে হবে।’
‘নগর সরকার’ চান শাহাদাত
সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ওপর জোর দিয়েছেন নতুন মেয়র শাহাদাত হোসেন। এক্ষেত্রে নগর সরকার গঠনই সমাধান হতে পারে বলে মত মেয়রের।
শাহাদাত বলেন, ‘সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করার জন্য নগর সরকার দরকার। নগর সরকার হলে সমস্ত সেবাদানকারী সংস্থাগুলো সিটি করপোরেশনের জনপ্রতিনিধির অধীনে আসবে। এতে কাজের মধ্যে শৃঙ্খলা আসবে। আমি যেসব সেবাদানকারী সংস্থা আছে, তাদের মধ্যে সমন্বয় করবো। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমি সবার সঙ্গে বসতে চাই।’
‘হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর কোনো দরকার নেই’
রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের উদ্দেশে মেয়র বলেন, ‘হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে আমি অনেককিছু জানি। আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, বাড়ি আছে, সেখানে কী ঘটনা হয়, কী করেন আমি সব জানি। আপনারা সাবধান হয়ে যান। হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। যেটা দিয়ে আসছেন নগরবাসী, সেটা যদি ঠিকভাবে পাই, তাহলে সিটি করপোরেশনে বেতন নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু সেটাও তো আমরা নিতে পারছি না বিভিন্ন কারণে।’
‘আওয়ামী সরকারের আমলে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছিল। সেটার জন্য আপিল করতে করতে, অনেকে আগে যেটা ট্যাক্স দিতেন, সেটাও এখন আর দিচ্ছেন না, আমি জানি এটা। সুতরাং একটা জায়গায় এসে আমাদের এগুলো সব ফিনিশ করতে হবে। বারবার বলছি, হোল্ডিং ট্যাক্স আমার বাড়ানোর দরকার নেই। কিন্তু যেটা দিতেন সেটা যেন পাই।’
রাজস্ব কর্মীদের হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘মাঝখানে একটা গ্রুপ আছে যারা হোল্ডিং ট্যাক্স কমানোর কথা বলে, কিছু টাকা নিয়ে এদিক-ওদিক করেন। প্লিজ, আপনারা চসিককে দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানের দিকে নিয়ে যাবেন না। আপনারা সবাই বেতন পাচ্ছেন। দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। চসিককে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করেন। তাহলে বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো সমস্যা থাকবে না। বোনাস বছরে দু’বার পান না। চসিক স্বাবলম্বী হলে এটা নিয়ে কোনো সমস্যা থাকবে না।’
‘৪১ ওয়ার্ডে ৪১টা খেলার মাঠ করতে চাই’
চসিক মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমাদের পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই। টার্ফে একটা বিশেষ শ্রেণির ছেলেমেয়েরা খেলছে। এতে সমাজে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। কারণ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা সেখানে খেলতে পারছে না। বিনোদন খুব প্রয়োজন, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছোট্ট একটা মোবাইলের মধ্যে আমাদের সময়টা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এতে আমাদের চোখ নষ্ট হচ্ছে, মানসিকতা নষ্ট হচ্ছে, নার্ভের সমস্যা হচ্ছে। ছোট বাচ্চারা মোবাইলে এককেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সোসাইটির সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটা আমরা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে করার চেষ্টা করবো। ৪১টা ওয়ার্ডে ৪১টা খেলার মাঠ করে দেয়ার ইচ্ছা আছে।’
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হাসপাতাল আছে। মেমন হাসপাতাল একসময় প্রসূতিদের জন্য চট্টগ্রামে এক নম্বর হাসপাতাল ছিল। এটাকে আমি আবার এক নম্বর জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি হাঁটবো, সময় দেব। আমি তিনঘণ্টা অফিসে থাকবো, বাকি সময় হাঁটবো। আমি কাজ করতে চাই। চসিককে পরিবর্তনের জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।’
‘প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি উদ্ধার করবো’
একসময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকলেও পরে সাবেক মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের দখলে চলে যাওয়া বেসরকারি প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি উদ্ধার করা হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র শাহাদাত হোসেন। উল্লেখ্য, মহিউদ্দিনের ছেলে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
মেয়র বলেন, ‘প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের টাকা দিয়ে কেনা, আপানারা সবাই জানেন। আজ সেটা বেদখল হয়ে গেছে। আমরা যারা রাজনীতি করি, মুখে বড় বড় কথা বলি। কিন্তু ক্ষমতা চলে গেলে বোঝা যায়, অনেককিছু বের হয়ে আসে। এটা আমাদের উদ্ধার করতে হবে। ইনশাল্লাহ, এটা আমি করবো।’
চসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫২ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত ১৬ বছর শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু মান বৃদ্ধি পায়নি। অনেক শিক্ষিত যুবককে লেফটেন্যান্ট বানান ইংরেজিতে বলতে বললে পারবে না। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে, এটার কোনো বিকল্প নেই। নৈতিক শিক্ষায় সবাইকে শিক্ষিত করতে হবে। প্রতিটি স্কুলে সেটা করতে হবে। ১৪ ডিসেম্বর আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। কেন হত্যা করা হয়েছিল ? জাতির মেধাকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য করা হয়েছিল। আমরা একটি মেধাবী জাতি চাই, মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই।’
প্রশ্নোত্তর পর্ব
মেয়াদ দেড় বছরেরও কম – একথা স্মরণ করানোর মাধ্যমে সাংবাদিকদের কাছে গঠনমূলক সমালোচনা প্রত্যাশা করে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শেষ করেন মেয়র শাহাদাত হোসেন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন সনদ পাওয়া নিয়ে নগরবাসীর ভোগান্তির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, ‘আগেই বলেছি, আমরা একটা ক্রান্তিকাল পার করছি। একটা ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি ওয়ার্ডে সচিব আছেন। আবার তিন ওয়ার্ড মিলে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সবাই তো সার্টিফিকেট পাচ্ছেন। বাকিটা নির্বাচন পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরতে হবে।’
ফুটপাত উদ্ধারের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়েছি। ফুটপাত উদ্ধার কিংবা যে কাজটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমি শুরু করতে চাই। সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে একসাথে আনার কাজ করতে চাই। ফুটপাতের বিষয়ে ট্রাফিক বিভাগকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আরও যারা আছে, তাদের সাথে বসবো। যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, সব একটার পর একটা করার চেষ্টা করবো। আইন আছে, আইনের প্রয়োগ করবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ অল্প সময়ের মধ্যে যে কাজগুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো আমি করতে চাই। এখন আমার প্রায়োরিটি হচ্ছে, ডেঙ্গু। কেউ যাতে ডেঙ্গুর চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটা আমি করবো। পাশাপাশি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, এ কাজ তো আমাদের করতে হবে। এটাতে জোর দিতে চাই। রাজশাহীতে রাতে শহরের ময়লা পরিস্কার করে। দিনে ঝকঝকে থাকে। আমরাও রাতে ময়লা পরিস্কার করবো। আমি মাঝে মাঝে স্পটে গিয়ে তদারক করবো।’
সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শাহাদাত বলেন, ‘প্রকল্প নিয়ে আমি ডিপার্টমেন্টের সবার সঙ্গে বসবো। কাজ কতটুকু হয়েছে, সরেজমিনে দেখবো। কাজের মান যাচাই করবো। তারপর আমি একটা সিদ্ধান্ত নেব। দুর্নীতির দায় যাদের আছে, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’
জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, জলাবদ্ধতা নিয়ে এখন সিটি করপোরেশনের হাতে তেমন কোনো কাজ নেই। একটা প্রকল্প আছে শুধু বহদ্দারহাট থেকে বারইপাড়া পর্যন্ত খাল খনন, এটা ১২৬০ কোটি টাকার প্রকল্প। এটার কাজ চলছে, আমি সরেজমিনে দেখব। আর জলাবদ্ধতার মূল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ছালাম সাহেব ও আ জ ম নাছির সাহেবের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। নাছির সাহেব পারেননি প্রকল্প আনতে। ছালাম সাহেব পেরেছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ নিয়ে সিডিএর সাথে মিলে একটা সংবাদ সম্মেলন করবো। কাজ কতটুকু হয়েছে, কবে শেষ হবে- সেটা আমরা জনসমক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে বলবো।’
এসময় চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামসহ বিভিন্ন বিভাগের প্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠা এক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীকে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোটে বিজয়ী দেখিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করা হয়েছিল। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেনের প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয়েছিল ৫২ হাজার ৪৮৯।
নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে রেজাউল করিমসহ নয়জনকে বিবাদী করে মামলা করেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন। মামলা চলমান থাকা অবস্থায় মেয়রের দায়িত্ব পালন করছিলেন রেজাউল করিম চৌধুরী।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৯ আগস্ট তাকে অপসারণ করে। এর মধ্যে গত ১ অক্টোবর শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে রায় দেন আদালত।
২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেজাউল করিম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ষষ্ঠ নির্বাচিত পরিষদের প্রথম সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আইন অনুযায়ী, প্রথম সভার তারিখ থেকে পাঁচ বছর নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ। সে হিসেবে ২০২৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি অক্টোবরে শপথ নিলে শাহাদাত হোসেনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের মেয়াদ হবে ১৬ মাস। যদি পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাহলে তিন মাস আগে তাকে পদ ছাড়তে হবে। সেক্ষেত্রে মেয়াদ হবে ১৩ মাস।
সারাবাংলা/আরডি/এইচআই