Sunday 17 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কোন পথে বাংলাদেশের ক্রিকেট?

জুবায়ের তানিন, স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট
১৬ নভেম্বর ২০২৪ ১০:২৮

পাকিস্তান সফরে বাংলাদেশের যে দলটাকে দেখেছিলেন, তিন মাসের ব্যবধানে সেই দলটাকে কি খুঁজে পাচ্ছেন? পারফরম্যান্স, শারীরী ভাষা, ক্রিকেটের প্রতি অ্যাপ্রোচ, গেম অ্যাওয়ারনেস, জয়ের মানসিকতা— সবকিছু মিলে কি আগের সেই দলটার সঙ্গে কোনো সাদৃশ্য পাচ্ছেন? আগস্ট-সেপ্টেম্বর মিলিয়ে দেশের টেস্ট ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দেওয়া দলটা কোথায় হারাল?

পাকিস্তানে দারুণ এই সাফল্যের পর উড়তে থাকা দলটাই গিয়েছিল ভারত সফরে। সেখানে টেস্টের পর টি-টোয়েন্টি সিরিজেও হোয়াইটওয়াশড। ঘরের মাঠে ফিরেও বদলায়নি ভাগ্য। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাটাও করতে পারেননি ক্রিকেটাররা দল হিসেবে। অথচ বলাবলি হচ্ছিল, হোম কন্ডিশনে ২-০ ব্যবধানেও জেতার সুযোগ আছে বাংলাদেশের। প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডেতেও তথৈবচ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে শারজায় ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হার।

বিজ্ঞাপন

ভিন্ন ফরম্যাটের আলাদা এই চারটি সিরিজে সবচেয়ে প্রকট ছিল বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা। পাকিস্তান সফর বাদ দিলে বোলিং ইউনিট হিসেবেও খুব আহামরি পারফরম্যান্স দেখা যায়নি। ব্যাটিং ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া বাংলাদেশ দলের হারের ধরন নিয়েও কথা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে— কী হলো বাংলাদেশ ক্রিকেটের?

দলের পারফরম্যান্সে যখন ক্রিকেটপ্রেমীদের মাথায় হাত, সাবেক ক্রিকেটার আর ক্রিকেট কোচরা তখন একেবারেই বিস্মিত নন। বরং তারা বলছেন, জাতীয় দলসহ এর আশপাশে থাকা ক্রিকেটারদের দক্ষতা-সক্ষমতা আর সামর্থ্য বিচারে দলীয় পারফরম্যান্স এমনই হওয়ার কথা! ওয়ানডে ক্রিকেটে ২০১৫ সালের আশপাশের কিছু সময় বাদ দিলে দেশের ক্রিকেটের চিত্র সব ফরম্যাটে মোটাদাগে এমনই ছিল।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে অনিয়মিতভাবে যৎসামান্য যেসব সাফল্য এসেছে, সেসবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে দুর্বলতাগুলোকে আড়াল করে ফেলার চর্চায় দলের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু প্রত্যাশা করাটাই বরং বাস্তবতাবিরোধী। ক্রিকেটারদের দক্ষতা-সামর্থ্য থেকে শুরু করে ক্রিকেট অবকাঠামোর প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা খুঁজে পাচ্ছেন দুর্বলতা।

পরিকল্পনাহীনতার খেসারত

একদম গোড়াতেই জাতীয় ক্রিকেট দল নিয়ে পরিকল্পনাহীনতা খুঁজে পাওয়ার কথা জানালেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান বুলবুল একসময় জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেছেন। বর্তমানে কর্মরত আইসিসির ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে।

বুলবুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৫ বা ১৭ বছর আগের একটা গল্প বলি। তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) যারা ছিলেন, তারা বাংলাদেশের ক্রিকেট কৌশল নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। তখন আমি একটা খবরের কাগজে একটি লেখায় তাদের নাম ধরে বলেছিলাম, আপনারা এমন একটি কৌশল বা পরিকল্পনা তৈরি করুন যে আগামী পাঁচ বছর পর আপনি অস্ট্রেলিয়া-ভারতের সঙ্গে নিয়মিত খেলবেন, নাকি আফগানিস্তান-জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিয়মিত খেলবেন? ঠিক এই কথাটিই বলেছিলাম। তখন থেকে আজ কিন্তু আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। এ কারণেই কিন্তু আমরা এখনো জিম্বাবুয়ে-আফগানিস্তানের সঙ্গেই খেলি বেশির ভাগ ম্যাচ।’

অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান ও জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল

পরিকল্পনাহীনতার এই চর্চার কারণেই দলীয়ভাবেও নিজেদের মানকে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি বলে মনে করছেন বুলবুল। তিনি বলেন, ‘এ কারণে আফগানিস্তানের কাছে সিরিজ হারের পরও আমাদের মনে হয় শক্ত দলের কাছে সিরিজ হারলাম। আবার নেপালের সঙ্গে দুয়েক রানের ব্যবধানে জিতেও মনে হয় আমরা অনেক সাফল্য অর্জন করেছি। আমাদের পুরো ক্রিকেটের মান আমরা কোথায় নামিয়ে এনেছি!’

‘হ্যাঁ, আমরা হঠাৎ করে পাকিস্তানকে টেস্ট সিরিজে হারিয়েছি, নিউজিল্যান্ডকেও টেস্টে হারিয়েছি। কিন্তু আমাদের রেগুলার যে পারফরম্যান্স, সে অনুযায়ী আমরা তলানিতে পড়ে আছি। র‍্যাংকিংও বলে, আমরা শেষের দিকে দল। আফগানিস্তান সিরিজের কথা বললাম, কারণ আমি তখন স্বপ্ন দেখতে বলেছিলাম। স্বপ্ন দেখেননি, এখন আফগানিস্তানের কাছে ২-১ ব্যবধানে হেরেও মনে হয় আমরা ভালো লড়াই করেছি। পুরনো একটি দলের জন্য এটা লজ্জার। টেস্ট ক্রিকেটে দুই যুগ পার হয়ে যাওয়ার পরও আমরা কোথায় পড়ে আছি,’— বলতে বলতে যেন শুধু আক্ষেপই ঝরছিল বুলবুলের কণ্ঠে।

মাঝে মাঝে ভালো খেলাতেই সন্তুষ্টি

মাঝে মাঝে দুয়েকটি ম্যাচ বা সিরিজ জয় নিয়ে আত্মতুষ্টিকে দলের ধারাবাহিক সাফল্য না পাওয়ার কারণ হিসেবে তুলে ধরলেন বাংলাদশের অভিষেক টেস্ট দলের প্রধান কোচ সারওয়ার ইমরান। সাম্প্রতিক সিরিজগুলোর বিশ্লেষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অনেকদিন পরপর আমরা দুয়েকটা ম্যাচ জিতি। ওইটা নিয়ে আমরা অনেক কিছু বলি। ওয়ানডেতে আমরা হয়তো একটা স্ট্যান্ডার্ডে আছি, যদিও আফগানিস্তানের কাছে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হেরেছি। ওই হারা ম্যাচগুলোও জেতার মতো ছিল, আমরা জিততে পারিনি। কিন্তু টেস্টে হঠাৎ করে দুটি ম্যাচ জিতেছে, যেখানে পাকিস্তানের পারফরম্যান্সের ভূমিকা রয়েছে। প্রথম টেস্টে তাদের অনেক নামিদামি বোলাররা কিছুই করতে পারেনি।’

‘দ্বিতীয় টেস্টে তাদের বোলিং ইফেক্টিভ ছিল না। আমাদের বোলিং তাদের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। ওদের দলে তেমন ভালো স্পিনার ছিল না। এই সুবিধাগুলো আমরা নিতে পেরেছি। পাকিস্তান দলে অন্তর্কলহ ছিল। নতুন অধিনায়ক, টিম কম্বিনেশন ভালো ছিল না। আমরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি। তবে ওই সিরিজেও আমরা টেস্ট হারতে পারতাম মুশফিকের ওই ইনিংস কিংবা মিরাজ-লিটন ওই ব্যাটিং না করলে। তো এসব দেখে আমি যতটুকু বুঝি, আমরা মাঝে মাঝে ভালো খেলি। আর এটা নিয়েই আমরা মনে করি আমরা সবাইকে হারিয়ে দেবো,’— বলছিলেন সারওয়ার ইমরান।

খেলোয়াড়দের মান-দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন

সাধারণ সময়ে না হলেও দলের পারফরম্যান্স পড়তির দিকে থাকলে মাঝে মাঝেই প্রশ্ন ওঠে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের দক্ষতা ও মান নিয়েও। টেস্ট-ওয়ানডে কিংবা ফার্স্ট ক্লাস-লিস্ট এ ক্রিকেটের পরিসংখ্যান ঘাঁটলেও শীর্ষ দলগুলোর ক্রিকেটারদের সঙ্গে পার্থক্য ফুটে ওঠে। লাল বল বা সাদা বলের কোনো ফরম্যাটেই দলে ৪০ গড়ের কোনো ব্যাটার নেই। ৩০-এর নিচে বোলিং গড় থাকা বোলার খুঁজে পেতেও রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হবে।

আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ‘আমাদের শক্তি বা সামর্থ্য সম্পর্কে আমরা নিজেরা পরিষ্কার নই। নিজেদের শক্তি পরখ করার জন্য যে বিশ্লেষণ দরকার হয়, সেই বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা আমাদের নেই বললেই চলে। কৌশলগত নির্দেশনা ও লক্ষ্য লাগে যে এখানে আমি পৌঁছাব। এরপর সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে কী কী লাগবে, সেগুলো থাকতে হবে। আমরা তো এগুলো জানিই না।’

তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার আগে লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছিল— একটা ম্যাচ জিতবে, একটা হারবে বা ড্র করবে। সেখানে আমরা দুই ম্যাচ জিতে গেছি। এর আগে বিশ্বকাপে কিন্তু একেবারেই ভালো খেলিনি। পাকিস্তান সিরিজের পরও একেবারেই ভালো খেলিনি। সামর্থ্যের আলোচনায় অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা জানি না কোথায় আছি। আমরা কী— এটা জানা খুব জরুরি। আমরা কী পারি, কী পারি না— এগুলো জানতে হবে। কোনো দল বা সংগঠনের উন্নতির জন্য প্রথমে স্বাভাবিক হতে হয়। তারপর আপনি ওপরের দিকে যাবেন। আমরা স্বাভাবিক না।’

একসময়ের সেরা উইকেটরক্ষক-ব্যাটার ও জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট

এতদিনেও বাংলাদেশ দলে আন্তর্জাতিক মানের পর্যাপ্ত ক্রিকেটার তৈরি হয়েছে কি না— এমন প্রশ্ন তুললেন দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট। তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতিই অত শক্তিশালী না। ঘরোয়া ক্রিকেটে শক্ত কাঠামো নেই। অনেক ঘাটতি আছে। তারপরও কেউ ১০ বছর, কেউ ১২ বছর, কেউ কেউ পাঁচ-ছয় বছর ধরে খেলছে। এতদিন ধরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলেও যদি আপনি নিজেকে তৈরি না করতে পারেন, তাহলে বলতে হবে সেই খেলোয়াড়দেরও ব্যর্থতা আছে।’

শারজায় আফগানিস্তান সিরিজের সূত্র ধরে ক্রিকেটারদের ইনটেন্টের ঘাটতির কথাও বললেন পাইলট, ‘প্রথম ওয়ানডেতে আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নবী উইকেটে আটকে থেকে দলের রান ২০০ পার করে নিয়ে গেল। সেই রান তাড়া করতে গিয়ে একপর্যায়ে ছিল ২ উইকেটে ১২০। তখন কেউ ৪০-৫০ রানের একটা ইনিংস খেললেই কিন্তু ম্যাচ হাতে চলে আসে। সেখানে আমরা ২৩ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ৯২ রানে ম্যাচ হারলাম। এর কোনো ব্যাখ্যাই হয় না!’

ক্রিকেটারদের দক্ষতা-সামর্থ্যের জায়গায় অন্য দলগুলোর সঙ্গে পার্থক্য কোথায়, সেটি স্পষ্ট করে দিলেন কোচ সারওয়ার ইমরান। তিনি বলেন, ‘আমাদের খেলোয়াড়রা ১৯-২০ বছর বয়সে দলে ঢুকে যায়। অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডে ২৪-২৫ বছরের আগে দলে ঢোকাটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। ওখানে ওরা অনেক প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে, নিজেকে প্রমাণ করে। আমাদের এখানে কী হচ্ছে? হয়তো অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ভালো খেলেছে, ঘরোয়া ক্রিকেটে দুয়েকটা ম্যাচ ভালো খেলেছে— তাকে সুযোগ দিয়ে দাও। কেউ পারছে না, তার জায়গায় ওকে সুযোগ দিয়ে দাও। ঠিক আছে সুযোগ দিন, কিন্তু জটিলতাগুলোও তো বিবেচনায় রাখতে হবে।’

মানসিকভাবে প্রস্তুতির ঘাটতি

ক্রিকেটারদের মানসিক শক্তিমত্তার অভাবকেও ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনতে না পারার পেছনে বড় নিয়ামক বলে মনে করেন খালেদ মাসুদ পাইলট, খেলোয়াড়দের মধ্যে আত্মবিশ্বাস নেই। মাঠের যে চিত্রটা দেখা যায়, ম্যাচ জেতার জন্য যে টিম বন্ডিং দরকার, সেটা নেই। নির্বাচক, কোচ বা অধিনায়ক বদলে খুব বেশি লাভ নেই। কারণ খেলোয়াড় যারা খেলবে, যতক্ষণ না তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে ততক্ষণ দুয়েকটা পরিবর্তনে কোনো কাজ হবে না।’

দেশের প্রথম টেস্ট দলের কোচ সারওয়ার ইমরান, স্থানীয় কোচদের মধ্যে তাকে সেরাদের একজন বলে মনে চলেন সবাই

এ ক্ষেত্রে দলগতভাবেও নানা ঘাটতি দেখছেন সাবেক এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটার, ‘আমাদের আসলে অনেক কিছুর কমতি আছে। আমরা সবসময় রেজাল্ট চাই। কিন্তু রেজাল্ট তো রাতারাতি আসবে না। কিছু কিছু জায়গা আছে, দেখে মনে হয় আমরা কেবল দলের প্রতিনিধিত্ব করতেই যাচ্ছি। কিন্তু একটা মিশন নিয়ে যাওয়া যে আমি প্রত্যেকটা জায়গা থেকে মানসম্পন্ন জিনিস নিয়ে যাচ্ছি, তাহলে ফল আসবে। প্রস্তুতিটা তেমন লাগবে, মানসিকতা লাগবে। খেলোয়াড়দের নিবেদন থাকতে হবে। কোনো কারণে এসবের কোথাও ঘাটতি আছে। যার কারণে ফলাফলটা বের করা যাচ্ছে না।’

২ যুগে টেস্টে আদৌ এগিয়েছে বাংলাদেশ?

সম্প্রতি টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ পথচলার দুই যুগ অতিক্রম করেছে। তবে টেস্টের কুলীন এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের অর্জনকে হতাশাজনক ছাড়া অন্য কোনো শব্দে অভিহিত করার সুযোগ নেই। পরিসংখ্যান বলছে, এই ২৪ বছরে বাংলাদেশ দেশ খেলেছে ১৪৮টি। এর মধ্যে জয় এসেছে মাত্র ২১টিতে, ড্র রয়েছে ১৮টি। বাকি সব ম্যাচেই সঙ্গী পরাজয়। টেস্ট ক্রিকেট কি তাহলে আদৌ দুই যুগে কিছু এগোল?

একসময়কার জাতীয় ক্রিকেট দলের মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়ের নির্ভরতার প্রতীক আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সাফ জবাব, ‘না’। তিনি বলেন, ‘এগোল কোথায়, আরও তো পেছাল! পেছালো বলতে বোঝাচ্ছি, আমরা নবীনতম দল আফগানিস্তানের কাছে সিরিজ হারি। ওদের সঙ্গে খেলতে ভয় পাই। আসলে এত কিছু বলারও দরকার নেই। পৃথিবী চলে রঙ ও সংখ্যার ওপর। কেউ ভালো করলে সবুজ, মাঝামাঝিতে অ্যাম্বার, খারাপ করলে লাল রঙ হয়। আমাদের র‍্যাংকিং বলে দেয়, আমরা লাল। আমরা ১২ দলের মধ্যে ৯-এ পড়ে আছি।’

কোচিং স্টাফসহ বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট দল

পাইলটের মূল্যায়ন কাছাকাছিই, ‘টেস্টে খুব বেশি এগোতে পারিনি। ২০০০ থেকে ২০০৮-০৯ সালের কথা যদি বলি, দেখা গেল আমরা তিন সিঁড়ি উঠেছি, এক সিঁড়ি নেমে গেছি। আবার হয়তো আরও এক সিঁড়ি উঠেছি, দুই সিঁড়ি নেমে গেছি। দুই যুগের গ্রাফটাও খুব ওপরের দিকে না। ভারত-অস্ট্রেলিয়া, এমনকি শ্রীলংকায় যে ক্রিকেট সংস্কৃতি, আমাদের অন্তত তাদের কাছাকাছি যাওয়া উচিত ছিল। কারণ বাংলাদেশের ক্রিকেটের জমি খুব উর্বর, যেখানে ১৮ কোটি মানুষ ক্রিকেট পছন্দ করে। কিন্তু সেই জমি আমরা কাজে লাগাতে পারিনি।’

কোচ সারওয়ার ইমরানও দেশের টেস্ট খেলার ধরনে ২৪ বছরের আগের ও পরের সময়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখছেন না, ‘তখন আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, হাবিবুল বাশাররা যেভাবে খেলত, এখনকার খেলার মধ্যেও তাদের সঙ্গে খুব একটা তফাত দেখি না। প্রথম টেস্টে প্রথম ইনিংসে আমরা ৪০০ করেছিলাম, দ্বিতীয় ইনিংসেই আবার ৯১ রানে অলআউট। এখনো তো তেমনই হয়। ওয়ানডে ক্রিকেটে কিছু পার্থক্য আছে, টেস্টে পার্থক্য দেখি না। এটাই বলে দেয়, আমাদের টেস্ট ক্রিকেট কতটা এগিয়েছে।’

দেশের ক্রিকেটের সংকট উত্তরণের উপায় কোন পথে?

এতসব হতাশার মধ্যে দেশের ক্রিকেটের ঘুরে দাঁড়ানোর কি তাহলে আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে? থাকলে করণীয়টাই বা কী?

যে ক্রিকেট অবকাঠামোর মধ্য দিয়ে খেলোয়াড়রা বেরিয়ে আসছে, সেদিকে নজর দিতে বলছেন কোচ সারওয়ার। তিনি বলেন, ‘আমি কোন বোলিংয়ের বিপক্ষে এখানে রান করছি, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে দলের বিরুদ্ধে রান করছি তারা দল হিসেবে কেমন, তাদের টিম স্পিরিট কেমন, ওই দল কয়টা ক্যাচ ছাড়ে এক ইনিংসে— এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয়। ভালো বোলার, ভালো ফিল্ডারদের দলের বিপক্ষে রান করলে ভালো ব্যাটার আসবে। কিন্তু আমাদের এখানে হয়তো দলে একজন-দুজন বোলার ভালো থাকে, বাকিরা সেই মানের না। বোলারদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভালো ব্যাটারদের বিপক্ষে খেলে উইকেট পেতে হবে। আবার এখানকার উইকেটে আনইভেন বাউন্স থাকে, লো উইকেট হয়— এগুলো বোলার বা ব্যাটার কাউকেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাহায্য করে না। এসব দেখতে হবে।’

আমিনুল ইসলাম বুলবুলও শুরুতেই জোর দিতে বলছেন ঘরোয়া ক্রিকেটের দিকে, ‘ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে কথা বলা উচিত আমাদের। আমাদের খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে দলে জায়গা পোক্ত করে। কিন্তু এসএসসির আগে যেমন টেস্ট বা প্রি-টেস্ট দিতে হয়, এই চর্চা আমাদের দেশের ক্রিকেটে নেই। দেশের ক্রিকেটের অবকাঠামো, মাঠ— এসব নিয়ে কথা বলতে হবে। আমাদের টেস্ট ভেন্যু পড়ে থাকে সারা বছর। আমাদের জেলাগুলোতে ঠিকমতো লিগ হয় না।’

বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে বড় জুটি গড়েছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও হাবিবুল বাশার সুমন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখনো সেই ২৪ বছর আগের দলের মতোই ক্রিকেট খেলছে। ছবি: শামসুল হক টেংকু

ক্রিকেটার তৈরিতে মনোযোগী হওয়ার কথা জানিয়ে বুলবুল বলেন, ‘পকেটে টাকা থাকলে দোকানে গিয়ে দামাদামি করা যায়। কিন্তু আমাদের তো পকেটে তো টাকাই নাই, মানে খেলোয়াড় নাই। তিন ফরম্যাটে ২৫ জন খেলোয়াড় দাঁড় করানোই তো কঠিন আমাদের পক্ষে। আমাদের বাচ্চাদের খেলাতে হবে, প্রতিযোগিতা থাকতে হবে। লেগে থাকতে হবে। তাহলে আস্তে আস্তে সব বদলাবে।’

চটজলদি ফলাফলের প্রত্যাশা না করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় জোর দেওয়ার কথা জানালেন পাইলট। তিনি বলেন, ‘রাতারাতি কী করে হবে? ঘুণে ধরা একটা কাঠ রাতারাতি কী করে ভালো করে ফেলবেন? আপনাকে চিন্তা করতে হবে ধাপে ধাপে। প্রথমত, তিন মাস বা ছয় মাসের মধ্যে আমি এই কারেকশনগুলো করব যে কোথায় কোথায় ইমপ্রুভ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তা করতে হবে— পরের পাঁচ বছরের মধ্যে আমি কোন জিনিসগুলো ডেভেলপ করব। এ রকম পরিকল্পনা করতে পারলে তবেই পরিবর্তন আসবে।’

তবে এ ধরনের পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা শিগগিরই দেশের ক্রিকেটে দেখতে পারছেন না বুলবুল, পাইলট বা সারোয়ার। কারণ উন্নতির জন্য বিবিসি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে যেসব পরিবর্তন বা উদ্যোগের প্রয়োজন, তার কিছুই দৃশ্যমান নয়। পাইলট বলছেন সে কথাই, ‘এই পরিবর্তনের হাওয়া আমি দেখতে পারছি না। পরিবর্তন বলতে সেই অর্থে আমি বড় কোনো পদক্ষেপ এখনো দেখছি না।’

বাংলাদেশের ক্রিকেটের পথের সামনে কি তাহলে শুধুই অন্ধকার?

সারাবাংলা/জেটি/টিআর

আমিনুল ইসলাম বুলবুল খালেদ মাসুদ পাইলট বাংলাদেশ ক্রিকেট বাংলাদেশ-আফগানিস্তান সিরিজ সারওয়ার ইমরান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর