বাতিল হচ্ছে উড়াল সড়ক নির্মাণ প্রকল্প
১৭ নভেম্বর ২০২৪ ১০:২১
সুনামগঞ্জ: বর্ষার সময়ে বিচ্ছিন্ন থাকা হাওর অঞ্চলকে যোগাযোগের আওতায় আনতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলাকে ঘিরে ‘হাওর এলাকায় উড়াল সড়ক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রকল্পের আওতায় গত বছর দুটি প্যাকেজে মধ্যনগর পর্যন্ত লিংক রোডের কাজও শুরু হয়েছিল। এছাড়া উড়াল সড়ক কোন দিকে যাচ্ছে, সেটিও চূড়ান্ত করা হয়। এলজিইডি’র দায়িত্বশীল প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দফায় দফায় সরেজমিনে পরিদর্শন করে স্বপ্নের উড়াল সড়কের অ্যালাইনমেন্টও চূড়ান্ত করেছিলেন।
সুনামগঞ্জ জেলার সঙ্গে নেত্রকোনার সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে হাওরে উড়ালসড়ক নির্মাণের এই প্রকল্প নিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। গত ৩১ অক্টোবর পরিকল্পনা কমিশনের এক সভায় এই প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। বলা হয়, সুনামগঞ্জে উড়ালসড়ক নির্মাণ হলে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
শুধু উড়াল সড়কই নয়; রেল, সড়ক, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি), দুর্যোগ, পরিবেশ, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া, অলাভজনক ও অগুরুত্বপূর্ণ’ প্রকল্প বাতিল করতে যাচ্ছে সরকার। ১০টি মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে অন্তত ৩৫টি প্রকল্পের খোঁজ পাওয়া গেছে, যেগুলো বাতিল, অর্থায়ন স্থগিত অথবা ব্যয় কাটছাঁট করা হবে। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় এক লাখ কোটি টাকার বেশি।
এর আগে, ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর তিন হাজার ৪৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হাওর এলাকায় উড়াল সড়ক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। হাওর সহিষ্ণু অবকাঠামো উন্নয়নপূর্বক হাওর অঞ্চলে সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন এবং উৎপাদিত কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণে সহযোগিতার লক্ষ্যে এই যোগাযোগ উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছিল।
২০২১ থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদে বাস্তবায়ন হবার কথা ছিল এই উড়াল সড়ক। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ছিলো স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। এতে সুনামগঞ্জে বর্ষার সময়ও জেলার প্রতিটি উপজেলার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, তেমনি নেত্রকোনার সঙ্গেও সুনামগঞ্জের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠতো। ঢাকার সঙ্গে সুনামগঞ্জের দূরত্ব কমতো।
হাওর অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ঠিক রেখে টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফি ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস) এক বছরব্যাপী সমীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছিল।
প্রকল্পের আওতায় হাওর এলাকায় ১৭০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ৯৭ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার অল সিজন (উচুঁ বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা সড়ক, যা সব মৌসুমে ব্যবহার করা যাবে) উপজেলা সড়ক, ২০ দশমিক ২৭ কিলোমিটার অল সিজন ইউনিয়ন সড়ক, ১৬ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার সাবমার্জিবল (বর্ষায় তলিয়ে যাবে শুষ্ক মৌসুমে যান চলাচল করবে) উপজেলা সড়ক এবং ২২ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার সাবমার্জিবল ইউনিয়ন ও গ্রাম সড়ক নির্মাণ। এ ছাড়া ১০ দশমিক ৮১ কিলোমিটার এলিভেটেড (উড়াল) সড়ক এবং ৫ হাজার ৬৮৮ মিটার দৈর্ঘ্যের ৫৭ টি ব্রিজ ও ১১৮টি কালভার্ট নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছিল।
গত বছরের মে মাসে এলজিইডি’র জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলা প্রকৌশলী মো. আনিছুর রহমান ও মো. জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছিলেন, সুনামগঞ্জ আব্দুজ জহুর সেতু পাড় হয়ে সাচনাবাজার সড়ক দিয়ে জামালগঞ্জের কুকরাপশি পর্যন্ত সড়ককে প্রশস্ত করা হবে। কুকরাপশি থেকে শামীম নগর, রামমন্দির হয়ে বেইলী রোড ক্রস করবে সড়ক। এরপর হাওরের ভেতর দিয়ে লম্বাবাক, কালীপুর, সদরকান্দি, মোমিনপুর বাজার হয়ে ছাতিধরা বিলের উপর দিয়ে যাবার কথা উড়াল সড়ক। বৌলাই নদীর পাশের কাজীরগাঁও গ্রামে গিয়ে জামালগঞ্জের সীমানা শেষ হবে। কাজীরগাঁও থেকে বাঘবাড়ী হয়ে মহেশপুর-রাজেন্দ্রপুরের মাঝখান দিয়ে যাওয়া উড়াল সড়ক জয়শ্রী গ্রামের একপাশ দিয়ে মলয়শ্রী গিয়ে শেষ হবার কথা ছিল। এখান থেকে আবার তিন হাজার ২০০ মিটার অর্থাৎ তিন কিলো ২০০ মিটার হবে অল ওয়েদার সড়কের প্রস্তাব ছিল। আবার কোয়ারপাড় থেকে কান্দাপাড়া পর্যন্ত ২২ শ মিটার অর্থা দুই কিলো ২০০ মিটার উড়াল সড়ক ছিল পরিকল্পনায়। সব মিলিয়ে প্রায় ১৩ কিলোমিটার হবার কথা ছিল উড়াল সড়ক। এই উড়াল সড়কের সঙ্গে যুক্ত করতে লংকাপাতাড়িয়া থেকে লক্ষণখলা বাজার পর্যন্ত আট কিলোমিটার এবং চামারদানি থেকে সাড়াকোণা পর্যন্ত চার কিলোমিটার সড়কের কাজ চলছে।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া এবং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের তালিকা করতে বলেছিলেন। এই নির্দেশনার পর ভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রকল্পের তালিকা তৈরি শুরু করে। যে ৩৫টি প্রকল্প বাতিল অথবা স্থগিত হতে যাচ্ছে, সেগুলোর কোনোটির কাজ মাঝামাঝি পর্যায়ে, কোনোটির কাজ মাত্র শুরু হয়েছে, কোনোটির কাজ এখনো শুরু হয়নি। কিছু প্রকল্প অনুমোদনের পর্যায়ে ছিল। মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, বাতিল অথবা স্থগিতের তালিকায় প্রকল্পের সংখ্যা আরও বাড়বে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া এবং অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাতিল করার পদক্ষেপটি সঠিক। সেই সঙ্গে সত্যিকার জনকল্যাণমুখী নতুন প্রকল্প নেওয়া দরকার, যদি অর্থায়ন পাওয়া যায়। তিনি প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে বর্তমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক সুরক্ষা ও সহায়তায় ব্যয় বাড়ানোর পরামর্শ দেন। জাহিদ হোসেন বলেন, এখন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা বাড়ানো যেতে পারে। দরিদ্র মানুষকে নগদ অর্থ দেওয়া যেতে পারে।
সুনামগঞ্জ এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন বললেন, উড়াল সড়ক প্রকল্প বাতিলের কোন চিঠি আমরা পাই নি। আমি পত্রিকায় দেখেছি প্রকল্পটি বাতিল হবে। তবে হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পর্যটক আকর্ষণের জন্য এই প্রকল্পটি এখানকার জন্য জরুরি।
সারাবাংলা/এনজে