বেরোবির শিক্ষক নিয়োগ আয়নাবাজি
এক রব্বানীর জায়গায় ১৪ বছর ধরে আরেক রব্বানী!
২৬ নভেম্বর ২০২৪ ২০:১১
রংপুর: সিনেমা নয়, বাস্তবেই এ যেন আরেক ‘আয়নাবাজি’র ঘটনা। যা ঘটেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে। অভিযোগ উঠেছে, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক নিয়োগে দুই চাকরিপ্রার্থীর নাম একই হওয়ায় আরেকজনের পাওয়া চাকরি দিব্যি ১৪ বছর ধরে করছেন গোলাম রব্বানী নামে এক ব্যক্তি। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললেও বাধ সাধল সরকার পরিবর্তনে। হঠাৎ করেই ভুক্তভোগীর এক চিঠিতে ফাঁস হয়ে গেল নিয়োগের আদ্যপান্ত। এমতাবস্থায় অভিযুক্ত গোলাম রব্বানীর নিয়োগ বাতিল করে বঞ্চিত গোলাম রব্বানীকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। এর পর নেওয়া হয় নিয়োগ পরীক্ষা। ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর বাছাই বোর্ডের সুপারিশ ১১তম সিন্ডিকেটে অনুমোদন করা হয়। সিন্ডিকেটের আলোচ্যসূচি মতে— নিয়োগের সুপারিশ ও অনুমোদনের জন্য প্রভাষক পদে রাজশাহী জেলার বাগমারার উপজেলার গোলাম রব্বানী এবং রংপুরের আরা তানজিয়াকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এই পদে অপেক্ষমাণ রাখা হয় মনিরুজ্জামান নামে আরেকজন প্রার্থীকে। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০৯ সালের ২২ ডিসেম্বর ভুক্তভোগী গোলাম রব্বানী (গোলাম রব্বানী, গ্রাম: বালিয়াডাঙ্গা, পো: নাসিরগজ, থানা বাগমারা, জেলা: রাজশাহীকে) নিয়োগপত্র পাঠানো হয়। যার স্মারক নম্বর: বেরোবি:/রেজি:/শিক্ষক নিয়োগ/৫০৬(০৬)০৯।
রাজশাহীর বাগমারার গোলাম রব্বানীর নিয়োগপত্রে বলা হয়, ‘সিন্ডিকেটের একাদশতম সভার অনুমোদনক্রমে আপনাকে নিম্নলিখিত শর্তাবলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর-এর ইতিহাস বিষয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগ প্রদান করা হলো।’
রাজশাহীর বাগমারার গোলাম রব্বানী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য মনোনীত হলেও নামের মিল থাকায় ওই পদে যোগ দেন আরেক গোলাম রব্বানী। হুবহু নামের মিল থাকা গোলাম রব্বানীর ঠিকানা হলো- গ্রাম-পূর্ব শুখানপুকুরী, উপজেলা-ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা-ঠাকুরগাঁও। তিনি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেও ওই সময় যোগ দিয়ে ১৪ বছর ধরে চাকরি করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, নিয়োগ পাওয়া বর্তমান সহযোগী অধ্যাপক গোলাম রব্বানীকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয় ২৭ ডিসেম্বর, যার স্মারক নং—বেরোবিঃ/রেজিঃ/শিক্ষক নিয়োগ/৫২৪/(০৬),০৯। সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চাকরি ফেরত পেতে ২৫ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার বরাবর অবেদন করেছেন বাগমারার গোলাম রব্বানী।
নিয়োগ বঞ্চিত গোলাম রব্বানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১০ সালের ২-৪ জানুয়ারির মধ্যে আমাকে যোগদান করতে বলা হয়। আমি ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি রেজিস্ট্রারের কাছে প্রভাষক পদে যোগদানপত্র জমা দিই। কিন্তু তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জলিল মিয়ার প্রশাসন যোগদানপত্র গ্রহণ না করে টালবাহানা করতে থাকেন। যোগদানপত্র গ্রহণের বিষয়টি পরে জানানো হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস আমাকে জানায়। পরে তৎকালীন উপাচার্য ও প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের যোগসাজশে বিপুল অর্থের বিনিময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে নামের মিল থাকার সুযোগ নিয়ে সুকৌশলে একই পদে অকৃতকার্য ঠাকুরগাঁওয়ের গোলাম রব্বানীকে নিয়োগ দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক ভিন্ন মতাদর্শের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে যোগদান করতে দেয়নি। পরে কয়েক দফা যোগাযোগের পর তৎকালীন ভিসি আব্দুল জলিল মিয়া পুনর্নিয়োগের আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। নিয়োগ বঞ্চিত হয়েও গত ১৪ বছর প্রতিবাদ করতে পারিনি আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের কারণে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উপাচার্যের কাছে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন জানিয়েছি।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হারুন-অর-রশিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘চাকরি ফেরত চেয়ে গোলাম রব্বানী নামে একজন প্রার্থী আবেদন করেছেন। এখন এটি যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়। প্রয়োজনে তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অভিযুক্ত ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম রব্বানীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তৎকালীন উপাচার্যের উপর দায় চাপিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে উল্লিখিত পদে যোগদান করতে চিঠি দিয়েছেন। এছাড়া আর কোনো ঘটনা আমার জানা নেই।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। ভুক্তভোগীকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। আমরা চাই, যেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।’
সারাবাংলা/পিটিএম