এইডস আক্রান্তদের ৪২ শতাংশ সমকামী
১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৫ | আপডেট: ১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:৪০
ঢাকা: চলতি বছর দেশে এইডস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ৪৩৮ জন। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভি (এইডসের ভাইরাস) পজিটিভ শনাক্ত হয়। এর পর চলতি বছর সর্বোচ্চ এইডস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৪২ শতাংশই সমকামী। তাদের মধ্যে ২৮ শতাংশ বা ৪০৬ জন রোগীই ঢাকা বিভাগের।
এছাড়া চট্টগ্রামে ৩২৬, খুলনায় ১৫৪, রাজশাহীতে ১৪৭ জন এইডস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য বিভাগে ৪৪ থেকে ৮৬ জন পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে চলতি বছর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় যক্ষ্মা, কুষ্ঠ ও এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (টিবি-এল অ্যান্ড এএসপি) সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বেড়েছে এইডস আক্রান্ত রোগী
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে গত বছর এইডস শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ২৭৬ জন যা চলতি বছরের তুলনায় ১৬২ জন কম।
দেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে দেশে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে বিগত ১০ বছর এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতি বছরই বেড়েছে।
সংক্রমণ বেশি সমকামীদের মাঝে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ৪২ শতাংশ সমকামী এইডস আক্রান্ত হয়েছে।
জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২৪ সালে নভেম্বর পর্যন্ত এইচআইভি সন্দেহজনক দুই হাজার ৪৯০ জনকে পরীক্ষা করে শনাক্ত হয় ১৮৮ জনের। এই সময়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। নতুন সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে সমকামী পুরুষ ৭১ জন।
জানতে চাইলে হাসপাতালটির জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. শ্রীবাস পাল বলেন, ১০ বছর আগে এইডসে আক্রান্তের সংখ্যা দুই গ্রুপের মধ্যে বেশি ছিল। এক হচ্ছে যৌনকর্মী, আর দ্বিতীয় হচ্ছে যারা যৌনকর্মীর সেবা গ্রহণ করত। কিন্তু গত দু-তিন বছরে আমাদের এখানে সমকামী পুরুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
তিনি বলেন, আমরা জেনেছি সমকামীদের মধ্যে অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইন অ্যাপসভিত্তিক গ্রুপে জড়িত। ধারণা করা হচ্ছে, এসব গ্রুপে যুক্ত রয়েছে কয়েক লাখ তরুণ। তাদের অনেকেই আক্রান্তের ঝুঁকিতে আছে।
চলতি বছর আক্রান্তদের মাঝে রয়েছে ২৪ শতাংশ সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া প্রবাসী শ্রমিক, যৌনকর্মী ও মাদকসেবী রয়েছে।
গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এইচআইভি সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এই সময়ে সংক্রমণের হার কমেছে যৌনকর্মী, মাদকসেবী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্যে। তবে বেড়েছে সমকামী ও প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে। সাধারণ মানুষের বেশির ভাগ আক্রান্ত হচ্ছেন বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিক দ্বারা।
বিবাহিতদের মাঝে আক্রান্তের হার বেশি
দেশে চলতি বছর এইডস আক্রান্তদের মাঝে ৫৫ শতাংশই বিবাহিত। তবে গত বছর শনাক্ত হওয়া এইডস রোগীর হার ছিল ৬০ শতাংশ। এছাড়া চলতি বছর এইডস আক্রান্তদের মাঝে বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত রয়েছেন পাঁচ শতাংশ।
শনাক্ত বেড়েছে অবিবাহিতদের মাঝে
দেশে গত বছর এইডস শনাক্ত হওয়া রোগীর মাঝে ৩১ শতাংশ ছিল অবিবাহিত। তবে চলতি বছর এইডস আক্রান্তদের মাঝে ৪০ শতাংশ অবিবাহিত। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার শনাক্ত হওয়া এইডস আক্রান্ত রোগীদের মাঝে ৯ শতাংশ অবিবাহিতের সংখ্যা বেড়েছে।
তরুণদের মাঝে ঝুঁকি বাড়ছেই
দেশে চলতি বছর এইডস আক্রান্তদের মাঝে ২১ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সসীমায়। গত বছরের তুলনায় এই পরিসংখ্যান পাঁচ শতাংশ বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে চলতি বছর এইডস আক্রান্তদের মাঝে ৬৩ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সসীমার মাঝে।
রোহিঙ্গাদের মাঝে কমেছে শনাক্তের হার
দেশে চলতি বছর মোট আক্রান্তের মধ্যে ১০ শতাংশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। গত বছর এ হার ছিল ১২ শতাংশ।
চলতি বছর অবশ্য অপরিবর্তিত রয়েছে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে এইডস শনাক্তের হার। চলতি বছর মোট সংক্রমণের ১ শতাংশ হিজড়া। গত বছরও তাদের মধ্যে সংক্রমণের হার এমনই ছিল।
কমেছে এইডস আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু সংখ্যা
দেশে ২০২৩ সালে ২৬৬ জন এইডস আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তবে চলতি বছর এইডস আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৯৫ জন।
অর্থাৎ বিগত বছরের তুলনায় এ বছর ৭১ জন রোগী কম মারা গেছে। চলতি বছর এইডস আক্রান্ত রোগীদের মাঝে মৃত্যুবরণ করেছে পুরুষ ৭৭ শতাংশ, নারী ২২ শতাংশ ও হিজড়া ১ শতাংশ । মৃতদের মধ্যে বেশির ভাগই ষাটোর্ধ্ব।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিসংখ্যান বিবেচনা করে সন্তুষ্ট থাকার উপায় নেই। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে যে এখনো অনেক রোগী শনাক্তের বাইরে।
এইডস চিকিৎসায় নেই বিশেষায়িত হাসপাতাল
দেশে ধারাবাহিকভাবে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও এখন পর্যন্ত বিশেষায়িত কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। রাজধানীর মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের পাশাপাশি এইডস রোগী ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারিভাবে এইডসের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় শুধু সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালেই। বেসরকারি পর্যায়ে এই সেবা নেওয়ার সুযোগ নেই। এইডস শনাক্ত করার জন্য সারাদেশে ২৭টি কেন্দ্র রয়েছে। আর চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় ১২টি কেন্দ্রে।
সংক্রামক ব্যধি হাসপাতালেত সিনিয়র কনসালট্যান্ট আরিফুল বাশার বলেন, এখানে জটিল রোগীদের ভর্তি রেখে সেবা দেওয়া হয়। শয্যা না থাকায় অনেককে ভর্তি নেওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়া এসব রোগীর চিকিৎসায় যে ধরনের ল্যাব সুবিধা থাকা জরুরি, তা নেই। অনেক সময় এইডস আক্রান্তদের অস্ত্রোপচার ও হার্টের রিং পরানো প্রয়োজন হলেও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসা দিতে চায় না।
তিনি বলেন, এইডস রোগীর অধিকাংশ সময় অধিক জ্বর, ডায়রিয়া, মুখে ঘা দেখা দেয়। এসব রোগী পরিচয় গোপন করে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত গর্ভবতীদের অস্ত্রোপচারে প্রসবের ক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা যায়। সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় সাধারণ রোগীর সঙ্গে রেখে তাদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের সিনিয়র ম্যানেজার (ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়) মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এইচআইভি সংক্রমিত রোগীর আজীবন ওষুধ খেতে হয়। এই ওষুধ সরকার বিনামূল্য দেয়। বিশেষায়িত হাসপাতাল হলে এক ছাদের মধ্যে এসব রোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান সম্ভব না হলে উপজেলা পর্যায়েও এই রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা সুবিধা থাকা প্রয়োজন।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাড়ায় শনাক্ত বেড়েছে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের টিবি-এল অ্যান্ড এএসপির লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. মাহফুজার রহমান সরকার বলেন, বৈশ্বিকভাবেই বয়সে নবীন জনগোষ্ঠী এইচআইভির ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। আমাদের এখানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আর মিয়ানমারে থাকতেই রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণ ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। রোহিঙ্গাসহ হিজড়াদের মধ্যে আসলে আগের চেয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বেড়েছে। তাই শনাক্তও হচ্ছে বেশি।
সচেতনতা বাড়ানো জরুরি
জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন এইডসের বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. সায়মা খান বলেন, এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত ও সেবার পরিধি বেড়েছে। তবে তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া রোধে প্রচারকাজ বাড়ানো যেতে পারে। আর পাঠ্যক্রমে এ বিষয়ে আরও সচেতনতামূলক বিষয় যুক্ত করা দরকার।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের প্রায় সব জেলা সদরের সরকারি হাসপাতালে এইচআইভি সংক্রমণ পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও উপজেলা হাসপাতালে তা নেই। উপজেলা পর্যায়ে এইচআইভি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার।
তিনি বলেন, এখন এইচআইভির চিকিৎসার ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত। তারপরও এত মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। মৃত্যুর কারণ হতে পারে নিয়মিত এবং যথাযথ চিকিৎসা নিচ্ছেন না আক্রান্ত ব্যক্তিরা। আবার যেসব ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, তা প্রতিরোধী হয়ে উঠছে কি না, সে বিষয়েও নজর দেওয়া দরকার।
১ ডিসেম্বর এইডস দিবস
বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও ১ ডিসেম্বর এইডস দিবস পালন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘অধিকার নিশ্চিত হলে, এইচআইভি/এইডস যাবে চলে’। দিবসটি উপলক্ষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।
সারাবাংলা/এসবি/এসআর
এইডস এইডস দিবস বেড়েছে এইডস আক্রান্ত রোগী সচেতনতা জরুরি সমকামী