Tuesday 03 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডেঙ্গু শনাক্ত নিশ্চিত করতে এনএসওয়ান-এলাইজা টেস্টের পরামর্শ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:৪৭

ঢাকা: দেশে সাধারণত সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানেই ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য প্রাথমিকভাবে এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি এনএসওয়ান-এলাইজা ও পিসিআরেও এই নমুনা পরীক্ষা করা যায়। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গু রোগের সকল ধরনের উপসর্গ থাকার পরেও প্রথম দুই থেকে পাঁচদিনের মাঝে নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসতে পারে।

ডেঙ্গু সংক্রমণ অধিকতর নিশ্চিত হওয়ার জন্য গবেষকরা বলছেন, শুধুমাত্র এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা না করে এর পাশাপাশি এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতেও সংক্রমণ শনাক্ত করা যেতে পারে। এর ফলে সঠিক সময়ে ডেঙ্গু সংক্রমণ নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসা শুরু করতে পারে রোগীরা।

বিজ্ঞাপন

গবেষকরা বলছেন, বর্তমানে এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে সরকার নির্ধারিত মূল্যে নমুনা পরীক্ষা করানো হচ্ছে দেশের সবখানে। বেসরকারি কিছু ল্যাবে পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করানো হচ্ছে। তবে সেটার মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ার কারণে গবেষকদের পরামর্শ, এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে সংক্রমণ শনাক্ত করানো।

মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টারের (নিলমারসি) অধ্যাপক ডা. মো. শামসুজ্জামান সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক গবেষণা কার্যক্রম অবহিতকরণ বিষয়ক আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা এ পরামর্শ দেন।

এ দিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্ল্যানিং, মনিটরিং এন্ড রিসার্চ অপারেশনাল ফান্ডের (পিএমআর) তত্ত্বাবধানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টারের (নিলমারসি) ভাইরোলজি বিভাগের ডেঙ্গু বিষয়ক একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

এ দিন অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান ডা. আরিফা আকরাম। গবেষণাটির প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। গবেষনাটির কো-ইনভেস্টিগেটর হিসেবে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ভাইরোলজী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তানিয়া ইসলাম রেশমা ও প্রতিষ্ঠানটির ভাইরোলজি বিভাগের মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. তাসনিম নাফিসা।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. শাহেদ আলী জিন্নাহ।

গবেষণা ফলাফল তুলে ধরে গবেষকরা জানান, প্রতি বছর দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর চার ধরনের সেরোটাইপের সবগুলোই আছে। এই রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মহামারী সংক্রান্ত সঠিক তথ্য খুবই জরুরি।

গবেষকরা জানান, গবেষণায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগের ল্যাবে ২০০ নমুনা পরীক্ষা করা হয় তিনটি পদ্ধতিতে। দেশে সাধারণভাবে ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য প্রাথমিকভাবে এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি এনএসওয়ান-এলাইজা ও পিসিআরেও এই নমুনা পরীক্ষার কার্যকরিতা বিশ্লেষণ করা হয়।

গবেষকরা আরও জানান, ২০২৩ সালের ডেঙ্গু মৌসুমে উপসর্গ থাকলেও অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ফলাফল নেগেটিভ আসে। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায় তাদের ডেঙ্গু সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। বিভিন্ন দেশের গবেষণায়ও এমন তথ্য জানা গেছে।

গবেষণা ফলাফল জানিয়ে গবেষকরা জানান, ডেঙ্গু রোগ শনাক্তের জন্য এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে ৯৪ শতাংশ কার্যকর। একই নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতি ৫৬ শতাংশ কার্যকর। পিসিআর পদ্ধতিতে শতভাগ কার্যকারিতা দেখা গেছে তবে এটি তুলনামূলকভাবে ব্যায়বহুল।

গবেষকদের মতে, ডেঙ্গু নির্ণয়ের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনটি পদ্ধতিই কার্যকরী। তবে স্বল্প মূল্যে দ্রুত ফলাফল পাওয়ার জন্য এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতি প্রাথমিকভাবে রোগ শনাক্তের জন্য উপযোগী। তবে এই পরীক্ষায় অনেক সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর রোগ নির্ণয় নিশ্চিতভাবে করা যায় না যাকে অনেকে ফলস নেগেটিভ রিপোর্টও বলে থাকেন।

গবেষকরা বলেন, তুলনামূলকভাবে এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে ডেঙ্গু ভাইরাস নিশ্চিত হওয়া যায়। এক্ষেত্রে এই পরীক্ষার মাধ্যমে পরিমাণগত ফলাফল পাওয়া সম্ভব, যা ভাইরাসের পরিমাণ নির্ধারণ এবং রোগের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে সহায়ক। পিসিআর পদ্ধতিতেও নিশ্চিত হওয়া যায় কিন্তু এটি ব্যয়বহুল এবং এর জন্য দক্ষ জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন, যা সব জায়গায় সহজলভ্য নয়।

গবেষকরা জানান, কোভিড মহামারীর সময়ে দেশের অনেক স্থানে পিসিআর মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে যদি ডেঙ্গু পিসিআর কিট সরবরাহ করা হয়, তাহলে পিসিআর করেও ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। কিন্তু পিসিআর এর চেয়ে এলাইজা পদ্ধতিতে করতে কম টাকা লাগবে। আর তাই এলাইজা পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করানোই সুবিধা।

গবেষকরা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সব ল্যাবরেটরিতে এলাইজা মেশিন রয়েছে বিধায় আমরা যার সহজেই ডেঙ্গু এনএসওয়ান-এলাইজা পরীক্ষাটির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গবেষণায়।

প্রধান গবেষক ডা. আরিফা আকরাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্তের জন্য সারাদেশে উপজেলা পর্যায়েও বর্তমানে এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। যেখানে বেশি মানুষের নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে সেখানে সুলভ মূল্যে এই পদ্ধতিতেই পরীক্ষা করানোটা সুবিধাজনক।’

তিনি বলেন, ‘তবে এই পদ্ধতিতে গত বছরের নমুনায় ফলস নেগেটিভ দেখেছি। এটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। গত বছরের নমুনাতেই আমরা ডেন-২ সেরোটাইপের উপস্থিতি দেখেছি। হতে পারে সেটা শনাক্ত হচ্ছে না বা কোনো কিছু পরিবর্তন হয়েছে যার ফলে নমুনা পরীক্ষায় ফলস নেগেটিভ ফলাফল আসছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নমুনা পরীক্ষায় ফলস নেগেটিভ মানে রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত না— বিষয়টা কিন্তু তেমনও না। এক্ষেত্রে যদি এনএসওয়ান-এলাইজা বা পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করানো হলে রোগ শনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যেহেতু পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা ব্যয়বহুল। তাই আমরা এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিচ্ছি।’

ডা. আরিফা আকরাম বলেন, ‘আমাদের উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সগুলোতে সিবিসি, ইএসআর মেশিন আছে। এক্ষেত্রে আমরা যদি সরকারকে বোঝাতে পারি যে এলাইজা পদ্ধতিতে স্বল্প খরচে বেটার ফলাফল আসে তবে অবশ্যই সেই সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সরকারিভাবে এলাইজা মেশিন সরবরাহ করা যেতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘যদি সেখানে সম্ভবত না হয় তবে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করানো যেতে পারে।’

গবেষণা বিষয়ে স্যার সলিমুল্লা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের ডা. তারেক মাহবুব খান বলেন, ‘আমরা দেখতে পারছি এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিত্র অনেকের মাঝে উপসর্গ থাকলেও সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে না। এটি রোগীর পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলতে পারে নানাভাবে। অনেকক্ষেত্রে অবশ্য চিকিৎসকরা সিভিসি পরীক্ষা করিয়ে সেটার মার্কার দেখেও সিদ্ধান্ত নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তবে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ শনাক্তের হার ভালো। আর তাই এটি একটি ভালো দিক।’

তিনি বলেন, ‘পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করালে অবশ্যই সেখানে সংক্রমণের সঠিন চিত্র দেখা যাবে। অর্থাৎ রোগীর রোগ শনাক্ত হবে। কিন্তু যেহেতু সেটি সবার জন্য সহজ লভ্য না। আর তাই এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করানো যেতে পারে।’

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ ইউসুফ বলেন, ‘এনএস-ওয়ান আইসিটি পরীক্ষায় সহজে ও অল্প সময়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা যায়। তবে এই পদ্ধতিতে অনেক সময় ভুল রিপোর্টও পাওয়া যায় বা শনাক্ত হয় না। এর ফলে সংক্রমণ শনাক্ত না হওয়ায় অনেকেই চিকিৎসাসেবার আওতায় আসতে চান না। এতে চিকিৎসা দেরিতে শুরু হয় আর তার ফলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে।’

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্যার সলিমুল্লা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের ডা. তারেক মাহবুব খান, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন, আইসিডিডিআর’বির গবেষক ডা. আমিনুর রহমান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পিএমআর বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (গবেষণা) ডা. মো. সাইফুল ইসলাম, ডিপিএম ডা. অনির্বান সরকার, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ ইউসুফসহ অন্যান্যরা।

সারাবাংলা/এসবি/এইচআই

এনএসওয়ান-এলাইজা ডেঙ্গু ডেঙ্গু শনাক্ত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর