গণমাধ্যমের চারটি বিষয় নিয়ে ১৭ সুপারিশ
‘নতুন বাংলাদেশ’-এর অভীষ্ট অর্জনে মুক্ত গণমাধ্যম অন্যতম পূর্বশর্ত : টিআইবি
৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৫৪ | আপডেট: ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:২২
ঢাকা: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা—গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন, ন্যায়বিচার, নির্ভীক মতপ্রকাশ, অবাধ চিন্তা ও বাক্ স্বাধীনতা নিশ্চিতে অপরিহার্য পূর্বশর্ত। নজিরবিহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর অভীষ্ট অর্জনে মুক্ত গণমাধ্যম অন্যতম পূর্বশর্ত।
এ প্রেক্ষিতে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় গণমাধ্যমের চারটি বিষয় নিয়ে ১৭ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এ সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে টিআইবি বলেছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা-গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন, ন্যায়বিচার, নির্ভীক মতপ্রকাশ, অবাধ চিন্তা ও বাক্ স্বাধীনতা নিশ্চিতের অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এই শর্তটির ব্যত্যয় ঘটলে, কী হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ নজিরবিহীন রক্তক্ষয়ী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরাজিত কর্তৃত্ববাদী সরকার । বিগত সরকারের আমলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ইস্যু আমাদের দেশে এতটাই নির্লজ্জ ও আত্মঘাতী আকার ধারণ করেছিলো, যা অতীতের সকল দৃষ্টান্তকে হার মানিয়েছে। এই সময় শুধু গণমাধ্যমের দলীয়করণই সম্পূর্ণ হয়নি এটিকে পুরোপুরি ক্ষমতাসীনদের মর্জিমাফিক তথ্য পরিবেশন তথা স্বার্থরক্ষা, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতিসহায়ক এবং কর্তৃত্ববাদ বিকাশের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে পরিণত করা হয়েছিলো। যার ফলাফলও হয়েছে মারাত্মক, গত ১৪ বছরে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২ ধাপ অবনতি ঘটেছে।
টিআইবি’র ১৭ দফা সুপারিশমালার মধ্যে আইন ও নীতিকাঠামোর বিষয়ক সুপারিশ রয়েছে পাঁচটি। এগুলো হচ্ছে-
১. বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের জন্য ৫০টি আইন ও নীতিমালা রয়েছে। যার প্রায় প্রতিটি সুস্থ সাংবাদিকতা বিকাশে কিছু কিছু সুযোগ সৃষ্টি করলেও, অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণমূলক। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার স্বার্থে এ সকল আইন, নীতি ও বিধিমালা যথাযথ পর্যালোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনে নতুন সমন্বিত গণমাধ্যম আইন প্রণয়ন এবং বিদ্যমানগুলো সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
২. গণমাধ্যমের মালিকানা বা লাইসেন্স সংক্রান্ত নীতি-কাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে দলীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থ দেখে লাইসেন্স বা প্রকাশনার অনুমতি দেয়ার প্রথা বন্ধ করা যায়। একইভাবে স্বার্থের বিপরীতে গেলে লাইসেন্স স্থগিত বা সম্প্রচার বন্ধ করার প্রবণতা চিরতরে রুদ্ধ করতে হবে।
৩. পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইনসহ গণমাধ্যমের নতুন নতুন ধারাকে অন্তর্ভুক্ত করে বিদ্যমান “প্রেস কাউন্সিলের” পরিবর্তে একটি স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৪. সাংবাদিকদের এক্রিডিটেশন কার্ড প্রাপ্তি ও বাতিল প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। এটি যেন দলীয় বিবেচনা বা ক্ষমতাশীলদের স্বার্থরক্ষায় কোনোভাবেই সচিবালয়ে সাংবাদিক প্রবেশ ঠেকানোসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয় । নাম সর্বস্ব গণমাধ্যমে সরকারি বিজ্ঞাপণ বরাদ্দের তুঘলকি কর্মকাণ্ড বন্ধে ডিএফপির নীতিমালাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে।
৫. বিটিভি, বেতার ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে একপাক্ষিক সরকারি প্রচারযন্ত্র হবার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিশ্চিত করতে না পারলে জনগণের অর্থে এ সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করাই শ্রেয় ।
গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সংক্রান্ত চার দফা সুপারিশ। এগুলো হচ্ছে-
১. অবিলম্বে দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ভয়ডরহীন উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সুস্পষ্ট ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
২. পতিত সরকারের দোসর অভিযোগে “উইচ হান্টিং” করে সাংবাদিক হয়রানির চলমান চর্চা অবিলম্বে বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। হুমকি-ধামকির মাধ্যমে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের প্রয়াস বিগত ক্ষমতাকাঠামোর জনবিরোধী চর্চার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৩. গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ ও হুমকি-হামলায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমসহ সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে “মব জাস্টিস” কঠোরভাবে
দমনে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. আইসিটি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার সিকিউরিটি আইনের অধীনে গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার।
এছাড়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাসহ সব হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের বিচারের আহ্বান জানানো হয়েছে টিআইবির পক্ষ থেকে।
সাংবাদিকদের পেশাগত উৎকর্ষতা বিষয়ে দেয়া হয়েছে ৩ দফা সুপারিশ। এগুলো হচ্ছে-
১. গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য অভিন্ন ওয়েজ বোর্ড প্রণয়ন ও নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করতে হবে।
২. সাংবাদিকতার ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার চর্চা নিশ্চিতের জন্য গণমাধ্যম খাতের নিজস্ব উদ্যোগে গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাগত নিরপেক্ষতা ও নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩. মালিকপক্ষের স্বার্থ, কর্পোরেট পুঁজি, রাজনৈতিক প্রভাব ও দলীয় পক্ষপাতমুক্ত গণমাধ্যম চর্চা বিকাশের লক্ষ্যে এ খাতের নিজস্ব উদ্যোগে মানবসম্পদ ও সম্পাদকীয় নীতিমালা, পেশাগত ও নৈতিক মানদণ্ড নিরূপণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
সাংবাদিক সংগঠন ও গণমাধ্যমের করণীয় বিষয়ক চার দফা সুপারিশ। এগুলো হচ্ছে-
১. গণমাধ্যমকর্মীরা যাতে চাকরির নিশ্চয়তা, নিয়মিত ও পর্যাপ্ত বেতন-ভাতার সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে এবং সকল প্রকার চাপ ও প্রতিকূলতা থেকে মুক্ত থেকে নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধানে সাংবাদিক সংগঠনসমূহকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
২. গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সার্বিক স্বচ্ছতা, আয়-ব্যয় এবং বিনিয়োগের উৎস, কর্মীনিয়োগ, বেতনকাঠামো এবং ওয়েজবোর্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. ভালো মানের সাংবাদিকতার জন্য প্রয়োজনীয় পেশাগত উৎকর্ষ, লজিস্টিক ও সক্ষমতা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
৪. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুরক্ষা নিশ্চিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য অংশীজনের সক্ষমতা, কর্মতৎপরতা ও পারস্পারিক সহযোগিতা এবং সমন্বয় গভীরতর ও ব্যাপকতর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সারাবাংলা/এসবি/আরএস