১১ ডিসেম্বর ১৯৭১— মার্কিন সপ্তম নৌ বহরের যাত্রা বঙ্গোপসাগর অভিমুখে
১১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:১০ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০২:৫৩
১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় যখন নিশ্চিত, তখন মার্কিন সপ্তম নৌ বহরের টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগর অভিমুখে রওনা দেয়। এ দিন ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির কাছে এক বার্তায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানান, মার্কিন সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছে। চীনও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে পরাজয় নিশ্চিত জেনে যুদ্ধবিরতির জন্য প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘ সদর দফতরে প্রস্তাব পাঠান। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত এ প্রস্তাব মেনে নিতে জোর দাবি জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউজের একজন মুখপাত্র বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত ও পাকিস্তান— উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক।
সন্ধ্যায় গোবিন্দগঞ্জে হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে আক্রমণ ও সারা রাত যুদ্ধ শেষে ভোরে গোবিন্দগঞ্জের পতন ঘটে। জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে সাময়িক সময়ের জন্য বিমান হামলা স্থগিত হয়।
জামালপুর, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, চণ্ডীপুর, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ফুলছড়িহাট ও বাহাদুরবাদ ঘাটসহ মুক্ত হয় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ছয় দিনব্যাপী অবরোধ ও প্রচণ্ড যুদ্ধের পর এ দিন ভোরে জামালপুর হানাদারমুক্ত হয়। জামালপুর গ্যারিসনে অবস্থানকারী পাকিস্তানি বাহিনী ২১ বেলুচ রেজিমেন্টের ছয়জন কর্মকর্তা ও ৫২২ জন সেনা যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ২১২ জন হানাদার নিহত হন আর আহত হন ২০০ জন।
এ দিন মুক্ত যশোরের জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এগুলো হলো— যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ২৫ মার্চের আগের মালিককে সম্পত্তি ফেরত দান, সব নাগরিকের সমঅধিকার ও চারটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা। সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন এক সংবাদ সম্মেলনে যশোর সার্কিট হাউজে বলেন, ‘আমরা তাড়াতাড়ি সংবিধান রচনা করব, যা ২৪ বছরে পাকিস্তান করতে পারেনি।’
মুজিবনগর সরকার থেকে প্রকাশিত জনগণের উদ্দেশে এক নির্দেশনায় বলা হয়, ‘ওই খুনিগুলোকে (ধরা পড়া বা সারেন্ডার করা পাকিস্তানি সৈন্য) তোমরা মেরে ফেলো না, মুক্তিবাহিনীর হাতে ওদের হস্তান্তর কর। হয়তো ওদের বিনিময়ে আমরা জাতির পিতাকে উদ্ধার করতে পারব।’
মুজিবনগর সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তাঞ্চলের জনগণের কাছে ধরা পড়া হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর কাছে জনগণ ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে হস্তাস্তর করে। ঢাকার উপকণ্ঠে মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনার অবতরণ এবং বিভিন্ন এলাকায় ছত্রীসেনাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। হানাদার পাকিস্তানিদের ফ্ল্যাগ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাও ফরমান আলীর উদ্দেশে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণ করার শেষ সুযোগটুকু গ্রহণের আহ্বান জানান।
মুক্তিযুদ্ধের প্লাটুন কমান্ডার নির্মল চন্দ্র সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘১১ ডিসেম্বর নিলফামারী জেলার চিলহাটি উপজেলায় যুদ্ধ করছিলাম। সে দিন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হই আমরা। প্রায় ২৪ ঘণ্টাই আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল। সৈয়দপুরে ছিল হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। ফলে নিলফামারী জেলা একটু দেরিতে হানাদারমুক্ত হয়।’
তিনি বলেন, ‘চিলাহাটী থেকে যে রেল লাইনটি ভারতের দিকে গেছে, সেটি ধরেই আমাদের থেমে থেমে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ১১ ডিসেম্বরের স্মৃতি কখনও ভুলবার নয়।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর