Tuesday 21 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জরিপ আতঙ্কে চরের মানুষ
জমি রেকর্ড হয় অন্যের নামে, সক্রিয় ভূমিদস্যু চক্র

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:৫৭

রাজশাহী: রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের অধিবাসীদের কাছে জমি জরিপ মানেই আতঙ্ক। তারা বলছেন, জরিপ এলেই একজনের জমি রেকর্ড হয়ে যায় আরেকজনের নামে। আর এর নেপথ্যে রয়েছে একটি ভূমিদস্যু চক্র, যারা এই ‘কৌশল’ ব্যবহার করে প্রচুর জমির মালিক হয়ে গেছে। এবারও একই চক্র জমি জরিপের কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে বলে অভিযোগ চরের মানুষের। তারা আবারও জমি হারানোর আশঙ্কায় ভুগছেন।

এলাকাবাসী জানান, সম্প্রতি ইউনিয়নের দিয়াড় মানিকচক ও আষাড়িয়াদহ মৌজায় দিয়ারা সেটেলমেন্টের জন্য নোটিশ জারি করা হয়েছে। চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফার ছেলে গোলাম মোর্শেদ তোতা কয়েকদিন আগে এলাকার মসজিদে মসজিদে একটি চিঠি দিয়ে আসেন মুসল্লিদের পড়ে শোনানোর জন্য।

বিজ্ঞাপন

দিয়ারা সেটেলমেন্ট অপারেশন, রাজশাহীর চার্জ অফিসারের সই করা এই জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দিয়াড় মানিকচক ও আষাড়িয়াদহ মৌজায় মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) থেকে দিয়ারা জরিপ শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে এলাকাবাসীর বিরোধিতার মুখে আজ শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) পর্যন্ত সেখানে জরিপ কাজ শুরু কো সম্ভব হয়নি।

দিয়ারা জরিপ বন্ধের দাবিতে মঙ্গলবার বিকালে ইউনিয়নের দুই শতাধিক মানুষ ইউপি মোড়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। এ ছাড়া দিয়ারা সেটেলমেন্ট জরিপ না করতে গত ২ ডিসেম্বর এলাকাবাসী গণস্বাক্ষর করে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে একটি আবেদনও করেছেন।

আবেদনে বলা হয়েছে, নতুন জেগে ওঠা চরের জন্য দিয়ারা সেটেলমেন্ট জরিপ পরিচালিত হয়। কিন্তু এই চর কখনো ভাঙেনি। দিয়াড় মানিকচক ও আষাড়িয়াদহ মৌজায় এর আগে সিএস, এসএ ও আরএস রেকর্ডের সময় জোনাল সেটেলমেন্টের মাধ্যমে জরিপ করা হয়। কিন্তু এবার বিআরএস রেকর্ডের জন্য দিয়ারা জরিপ হবে বলে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সরকারি লোকের বাইরে এই জরিপ করা হলে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হবে। অনেক কৃষকের জমি আবার যাবে প্রভাবশালীর নামে। জরিপ করতে হলে তারা জোনাল সেটেলমেন্ট দাবি করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

এই ইউনিয়নের দুটি মৌজায় এর আগে ২০০৯ সালে জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তখন অনেকের জমি প্রভাবশালীদের নামে রেকর্ড হয়ে যায়। এমন জমির মালিকানা হারানো একজন আমতলা খাসমহলের রাফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, ৪০ বছর আগে তিনি একখণ্ড জমি কেনেন। পরে জানতে পারেন, ওই জমি প্রকৃতপক্ষে অর্পিত সম্পত্তি। বাধ্য হয়ে রাফিকুল প্রতিবছর সরকারকে রাজস্ব দিয়ে ওই জমি চাষবাস করেন। এতদিন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এই জমি রেকর্ড হয়ে গেছে এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যক্তির নামে।

রাফিকুলের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের আমতলা খাসমহলে। শুধু রাফিকুলের একার নয়, চর আষাড়িয়াদহের দুটি মৌজার প্রায় অর্ধশত ব্যক্তির জমি অন্যের নামে রেকর্ড হয়েছে। রাফিকুলের আশঙ্কা, যেকোনো সময় ভূমিদস্যু চক্রটি লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির হবে তার জমির দখল নিতে। তখন তিনি জমির দখল হারাবেন।

শুধু আমতলা খাসমহলেই রফিকুল, নায়েব আলী, আশাদুল ইসলাম ও সাইবার হকের তিন দশমিক ১৪ একর জমি জহির উদ্দিন, মজিবরসহ কয়েকজনের নামে রেকর্ড হয়ে গেছে। এ ঘটনা ঘটেছে ২০০৯-১০ সালের দিকে, যখন চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের আষাড়িয়াদহ খাসমহল ও হনুমন্তনগর মৌজায় দিয়ারা সেটেলমেন্টের মাধ্যমে বিআরএস রেকর্ড হয়।

আমতলা খাসমহলের বাসিন্দা তরজেমা খাতুন বলেন, দিয়ারা জরিপের সময় তার ভাই কামাল হোসেনের ১২ কাঠা জমি সানারুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির নামে রেকর্ড করে দেওয়া হয়েছে। তরেজাম বেগম বলেন, ‘টাকা দিয়ে চিট করে আমাদের জমি নিয়ে নিয়েছে। আমরা কেস করেছি। ওরা জমি দখল করব করব করছে। আমরা খুব আতঙ্কে আছি।’

নওশেরা গ্রামের মোজাহার আলী বলেন, আমার তিন বিঘা জমি দিয়ারা জরিপের সময় রেকর্ড করে দেওয়া হয়েছে মোস্তফা চেয়ারম্যানের (সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা) নামে। তখন মোস্তফা রানিং চেয়ারম্যান ছিল। জরিপের লোকজনকে পয়সা খাইয়ে করে নিয়েছে। পরে আমি মামলা করেছি। ১০ বছর ধরে মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে।’

ইউপি মোড়ে বিক্ষোভ করতে আসা চরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা একটি চক্র গড়ে তুলেছেন। ওই চক্রের সদস্যরা জরিপ এলেই খাসজমি, অর্পিত সম্পত্তি কিংবা সাধারণ কৃষকের জমিও নিজেদের নামে রেকর্ড করে নেন।

স্থানীয়দের দাবি, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. সানাউল্লাহও এভাবে অনেক জমির মালিক হয়েছেন। সাবেক এ দুই চেয়ারম্যান নিজের নিকটাত্মীয়দের নামেও জমি করেছেন। এ ছাড়া ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলাম, তোজাম্মেল হক, সাবেক ইউপি সদস্য কবির হোসেন, বারীনগরের কানা ফজলু, আমতলা খাসমহলের জহির উদ্দিন, মজিবর রহমান, ট্যাকপাড়ার সাইদুল ইসলাম ও আমতলার হুমায়ন কবির জরিপ এলেই নিজেদের নামে জমি রেকর্ড করে নেন। তাদের কথামতোই সব কাজ করেন জরিপ করতে আসা লোকজন।

স্থানীয় চিকিৎসক বরকত উল্লাহ বলেন, ‘চরে জরিপ হলো ভাইরাসের মতো। গতবার আমরা অনেক দুর্নীতি দেখেছি। এবার আমরা দেখছি জরিপ শুরুর আগেই কিছু অসাধু মানুষ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। অতীতে দেখেছি, একজনের জমি অন্যজনকে দিয়ে দিয়েছে।’

দিয়াড়মানিকচক গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে যা হয়েছে তা হয়েছেই। এবার যেন জরিপের সময় কেউ দুর্নীতি করার চেষ্টা না করে। কোনো দালালচক্র যেন এবার জরিপের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকে। তা না হলে এবার আমরা প্রতিরোধ করব।’

আষাড়িয়াদহ গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক শামসুল হুদা বলেন, ‘মোস্তফা চেয়ারম্যানের বাপের কোনো জমি ছিল না। এখন তার অনেক জমি। ছেলে এবং স্ত্রীর নামেও অনেক জমি করেছে সে।’

পানিপার গ্রামের শাহিন আলী বলেন, ‘গতবার এই রাঘব-বোয়ালরা অনেকের জমি রেকর্ড করে নিয়েছে। এবারও তারা জরিপের উদ্যোগী হয়েছে। মোস্তফা চেয়ারম্যানের ছেলেই নোটিশ জারি করে বেড়াচ্ছে।’

জানতে চাইলে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ সঠিক নয়। রাজনৈতিক কারণে লোকজন এটা বলতে পারে। আমি যদি কারও জমি নিজের নামে রেকর্ডই করি নিই, তাহলে তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে।’

চর আষাড়িয়াদহ ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম ভোলা বলেন, ‘গতবারের জরিপে একজনের জমি অন্যজনের নামে রেকর্ড করে দেওয়া হয়েছে। ফলে সামাজিক বিরোধ বেড়েছে। আমি আসার পরে অন্তত অর্ধশত অভিযোগ পেয়েছি। এগুলো মীমাংসাও হচ্ছে না। অনেকে দিনের পর দিন মামলা-মোকদ্দমা চালাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘নতুন জেগে ওঠা চরের জন্য দিয়ারা জরিপ হয়। কিন্তু এই চর কখনো ভাঙেনি। তাই এখানে দিয়ারা সেটেলমেন্ট আমরাও চাই না। এখানে যেন সরকারি লোকজন দিয়ে আগের মতোই জোনাল সেটেলমেন্ট জরিপ করা হয়। তা না হলে আবারও একজনের জমি অন্যজনের নামে হয়ে যাবে।’

জানতে চাইলে দিয়ারা সেটেলমেন্ট অপারেশন, রাজশাহীর চার্জ অফিসার সলিল কিশোর চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্থানীয় ভূমি মালিকদের আপত্তি থাকলে তো আমরা জরিপ করতে পারব না। সেটা আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।’

গতবারের জরিপে একজনের জমি অন্যজনের নামে রেডর্ক করে দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এবার সেটা হবে না। এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে জরিপ হচ্ছে।’

সারাবাংলা/ইআ/টিআর

জমি জরিপ জমি রেকর্ড ভূমিদস্যু রাজশাহী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর