‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ’
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৪২ | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:৫৩
ঢাকা: তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা শুধু সাংবিধানিকই নয়, একইসঙ্গে সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল শুধু অবৈধই নয়, যেহেতু নির্বাচন, গণতন্ত্র সংবিধানের মূল কাঠামো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি অংশ। যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গণতন্ত্র এবং নির্বাচনকে সুসংহত করে, সেহেতু এটিও সংবিধানের একটি মূল কাঠোমো।
মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করার বিষয়টিকে অবৈধ বলে ঘোষণা করা রায়ে এ কথা বলেন হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
এ দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন বাতিল প্রশ্নে জারি করা রুল আংশিক যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া বলেন, তত্ত্বাবধায় সরকারব্যবস্থা বাতিল করার ফলে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল। একইসঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থাও ধ্বংস করা হয়েছিল। এর ফলে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন চালু হয়েছিল। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলকে অবৈধ ঘোষণা করা হলো।
পঞ্চদশ সংশোধনীর এই অবৈধ ঘোষণার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এখনই ফিরে এসেছে বলা যাবে না। কারণ এই ব্যবস্থাকে দুইভাবে বাতিল করা হয়েছিল। প্রথমত, বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ একটি রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। পরে সংসদ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেন। আপিল বিভাগের ওই রায়ের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) রায়ে পরিবর্তিত হতে হবে। এ বিষয়ে একটি রিভিউ শুনানিতে আছে।
আরও পড়ুন- ‘অন্তবর্তী সরকারই হতে পারে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার’
তিনি বলেন, জ্ঞানপাপী একজন জাস্টিস (বিচারপতি) ছিলেন। তার নাম খায়রুল হক। মূল রায় থেকে ডেভিয়েশন করে (পথভ্রষ্ট) ১৭ মাস পর রায় প্রকাশের সময় তিনি বলেন, পরবর্তী দুটি নির্বাচন কোন ফর্মে হবে তা সংসদে ঠিক হবে। তাদের থেকে দলছুট হয়ে সিনহা বাবু (বিচারপতি এস কে সিনহা) বলেন, আগামী দুটি নির্বাচনই হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। খাইরুল হকের সঙ্গে তাল মেলালেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, হাইকোর্ট আজ রায়ের মধ্যে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবিধানিকভাবেই বৈধ সরকার। ১০৬ অনুচ্ছেদের প্রেক্ষাপটে মতামত নিয়ে করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ফুল বেঞ্চ মতামত দিয়েছেন, এটি সাংবিধানিক ওপিনিয়ন। আপিল বিভাগ সাংবিধানিক মতামতে বলেছেন, রাষ্ট্রপতি ওনাদের কাছে বলেছেন, সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলে গেছেন, অন্য কাউকে ডেকে সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে আইনি কোনো বাধা আছে কি না। সুপ্রিম কোর্ট গোটা প্রেক্ষাপট বিবেচনা নিয়ে বলেছেন, এটা বৈধ ও সাংবিধানিক সরকার হবে। এর সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সাংঘর্ষিক প্রভিশন নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে অর্তবর্তী সরকারই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামকরণ হবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, বর্তমান অন্তবর্তী সরকারই পরবর্তী তত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হতে পারে। এই সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রিনেমড হবে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপিল বিভাগে যে রিভিউ পেন্ডিং আছে তা বাইপাস করেই এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কেন আছে? কারণ তত্ত্বাবধায়কের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে দুটি রেশিও। এক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈধ নাকি অবৈধ। এই পার্টে চারজন বলছেন অবৈধ, তিনজন বলছেন বৈধ। দ্বিতীয় পার্টে সবাই বলেছেন, পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হবে। এই যে পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হবে, তার আগেই পঞ্চদশ সংশোধনী চলে এসেছে। তাহলে ধরে নেওয়া যায়, ওই জাজমেন্ট রেশিও এখনো অপারেটিভ, কার্যকর। তাহলে কমপক্ষে আগামী দুটি নির্বাচন তো আপিল বিভাগের অ্যাটেনশন লাগে না।
রায়ের পর আইনজীবী শিশির মনির বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোপুরি বাতিল করেননি। কিছু জিনিস রেখে দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নিরাপত্তায় বিষয়টি সংরক্ষণ করেছেন।
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে যে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল তার পুনরিজ্জীবিত করা হয়েছে। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ বাতিল করে দেওয়ায় গণভোটের বিষয়টিও পুনরুজ্জীবিত করা হলো।
তিনি আরও বলেন, সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ৭ক এবং ৭খ অনুচ্ছেদের সংসদের যদি কেউ সংবিধানের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করে তাহলে সেটাকে সাংবিধানিক রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়টিও বাতিল করে দিয়েছেন। একইসঙ্গে ৪৪ অনুচ্ছেদ নিম্ন আদালতের কাছে উচ্চ আদালতের কিছু ক্ষমতা হস্তান্তর করার বিষয়টিও বাতিল করা হয়েছে। এর বাইরে সংবিধানে জাতির পিতা, ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাসহ পঞ্চদশ সংশোধনীতে আরও যে সমস্ত বিষয় রয়েছে সেগুলো পরবর্তী জাতীয় সংসদে সেখানে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বলেছে হাইকোর্ট। যেগুলো ভালো মনে করেন সেগুলো রাখবেন, সেগুলো অপ্রয়োজনীয় মনে করবেন সেগুলো বাতিল করবেন।
আলোচিত এই রিটের রুল শুনানিতে সুজনের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ও আইনজীবী ফারজানা শারমিন পুতুল। জামায়াতের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। ইনসানিয়াত বিপ্লব দলের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুর রউফ ও ইশরাত হাসান। এ ছাড়া রুল শুনানিতে পক্ষভুক্ত হওয়া সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার জুনায়েদ আহমেদ চৌধুরী।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন। রায় ঘোষণার সময় পক্ষভুক্ত হওয়া আইনজীবী ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ, ব্যারিস্টার শাইখ মাহদী, নাফিউল আলম সুপ্ত এবং সাইয়েদ আবদুল্লাহসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালে সংবিধানের ওই সংশোধনী আনা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়।
ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়।
অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি সংযোজন করা হয়।
সংবিধানের এই সংশোধনী বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে গত আগস্টে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি।
এরপর, ১৯ আগস্ট হাইকোর্ট রুল জারি করেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে।
পরে এই রুল সমর্থন করে সহায়তাকারী (ইন্টারভেনার) হিসেবে যুক্ত হন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গণফোরাম, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা। তাদের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
এ ছাড়া নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও রিট করেন। এরপর, ৪ ডিসেম্বর পৃথক রিটে জারি করা রুলের ওপর শুনানি শেষ হয়।
সারাবাংলা/কেআইএফ/ইআ