Thursday 06 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অচল ডেমু সচল করতে চান প্রকৌশলীরা, রেল কর্তাদের অনীহা

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:৩০

বাংলাদেশ রেলওয়ে। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: দীর্ঘদিন ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে ‘ডিজেল ইলেক্ট্রিক মাল্টিপল ইউনিট—ডেমু’ ট্রেনগুলো। চীনা প্রযুক্তিতে তৈরি এসব ট্রেন এবার দেশীয় প্রযুক্তিতে সচলের উদ্যোগ নিতে চান প্রকৌশলীরা। ডেমুগুলো সচল করা গেলে কমপক্ষে ২০ বছর চালানো সম্ভব বলে দাবি তাদের। এ ছাড়া, এতে খরচও হবে কম।— এই পরিকল্পনার কথা প্রকৌশলীরা এরই মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়েকে জানানিয়েছে। তবে এর দায় নিতে চান না রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বিজ্ঞাপন

তারা বলছেন, এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের ইতিবাচক মতামত পাওয়া গেলে ভেবে দেখবেন। যদিও এ নিয়ে টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান দেখছেন না যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।

কাছাকাছি দূরত্বে বেশি পরিমাণে যাত্রী পরিবহণের উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে সাড়ে ৬৫০ কোটি টাকা খরচ করে চীন থেকে কেনা হয় এই ডেমু ট্রেনগুলো। সরকারি খরচে চীনের তাংসান রেলওয়ে ভেহিকেল কোম্পানি লিমিটেড থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এই ট্রেন হালকা যান ও জ্বালানি সাশ্রয়ী হওয়ায় বর্তমানে উন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশে এর ব্যবহার দেখা যায়। বাংলাদেশের মতো জনবহুল রাষ্ট্রের বড় শহরগুলোতে কমিউটার ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বিবেচনায় নিয়েই ট্রেনগুলো কেনা হয়েছিল। কিন্তু ফলাফল মোটেই ভালো হয়নি।

২০১৩ সালে ২০ সেট ডেমু ট্রেন সংগ্রহের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ে মোট ৬০টি (৪০টি এমসি ও ২০ টি টিসি) রোলিং স্টক যুক্ত করা হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো মেরামত কারখানা তৈরি করা হয়নি। ঢাকা, পাহাড়তলী ও পার্বতীপুর লোকোসেডের জনবল দিয়েই ট্রিপ ইন্সপেকশন ও হালকা মেরামতের মাধ্যমে ডেমু ট্রেন পরিচালিত হয়ে আসছিল। সম্পূর্ণ নতুন টেকনোলজি, খুচরা মালামাল না পাওয়া এবং উচ্চ ব্যয়বহুল হওয়ায় ডেমু রক্ষণাবেক্ষণ শুরু থেকেই বিঘ্নিত হয়। ডেমু ট্রেনে মেকানিক্যাল ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যালের এমন প্রযুক্তি ছিল, যা বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য একেবারেই নতুন। যে কারণে রেলের প্রকৌশলীরা সেগুলো সারাতেও পারছিলেন না, আবার চীন থেকে সারিয়ে আনার কাজটিও ছিল ব্যয় বহুল। বলা চলে অভিজ্ঞতা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই ২০ সেট ডেমুর সবগুলোই বিকল হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

যখন ট্রেনগুলোও পড়ে পড়ে নষ্ট হওয়ার উপক্রম, তখন আশার আলো দেখালেন দেশেরই কয়েকজন প্রকৌশলী। চীন থেকে আনা নির্দিষ্ট সফটওয়্যারে পরিচালিত এসব ট্রেন সংস্কার করাই ছিল তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ডাকে অচল ডেমু ট্রেন সচলে এগিয়ে আসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ও আনবিক শক্তিকমিশনের সাবেক কর্মকর্তা প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান। চ্যালেঞ্জ নিয়ে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দেড় বছর পর দেশীয় প্রযুক্তিতে ছয়টি ডেমু ট্রেন সচল করতে সক্ষম হন তিনি ও তার টিম। ২০২২ সালের অক্টোবরে সেই সচল ডেমু ট্রেনের উদ্বোধন করে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে যাত্রী পরিবহণের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়।

ওই সময় বলা হয়েছিল, বিকল বাকি ডেমু ট্রেনগুলোও ধীরে ধীরে সচল করা হবে। যদিও পরে তা আর হয়নি। এদিকে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কিছুদিন পর ওই ছয় সেট ডেমু চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা ও অনীহা ছিল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যে কারণে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা অন্য ডেমু ট্রেনগুলো সচল করার প্রস্তাব আর এগোয়নি। যে কারণে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকায় কেনা ডেমু ট্রেনগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম ও পার্বতীপুরে দীর্ঘদিন ধরে অচল পড়ে আছে।

বর্তমান বাংলাদেশ রেলওয়েতে রোলিং স্টকের (ইঞ্জিন ও কোচ) তীব্র সংকট চলছে। এই পরিস্থিতিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে যানজট এড়িয়ে মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্নে ডেমুর মতো হালকা যানবাহন পরিচালনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। সেক্ষেত্রে ডেমু ট্রেন সচল করার জন্য পরামর্শও এসেছে। প্রকৌশলীদের দাবি, সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে কম খরচে অচল ডেমুগুলো সচল করা সম্ভব।

দেশীয় প্রকৌশলীরা বলছেন, ডেমু ট্রেনের ওপর দীর্ঘদিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে অচল পড়ে থাকা ডেমু ট্রেনগুলো আধুনিক ও সহজ বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে সহজলভ্য মালামাল দিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে টেকসইভাবে সচল করে যাত্রী পরিবহণে ব্যবহার করা যেতে পারে। তারা আরও বলেন, সিঙ্গেল সোর্স হিসেবে প্রতিটি ডেমু আমাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মাধ্যমে সচল করে মেরামতের পর দুই বছর ওয়ারেন্টি পিরিয়ডসহ রেলের কাছে অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হস্তান্তর করা হবে।

এ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘চালু করে দেখিয়ে দিতে চাই এটি (ডেমু) আরও ২০ বছর চালানো সম্ভব। যেগুলো মেরামত করে সচল করেছি সেগুলো এখনো ঠিক আছে। আমি শুনেছি, আমাদের সচল করা ডেমু ট্রেনগুলোর ইঞ্জিন এখন নাকি স্টার্ট হচ্ছে না। তারা (রেলওয়ে) আমাকে এ নিয়ে একবারও ডাকেনি। একবার সফল হয়েছি বলেই বাকিগুলো নিয়ে কাজ করতে চাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডেমুতে চীনের যে প্রযুক্তি সেট করা আছে সেটা পুরোপুরি পরিবর্তন করতে হবে।’ কিন্তু ট্রেনের বডির অংশের কী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডেমুর বডি ফাইবারের তৈরি। যা বাংলাদেশে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ড্রোনও ভিন্ন প্রযুক্তির। কিন্তু তা এখন দেশীয় প্রযুক্তিতে সচল করা হচ্ছে। রেলওয়ে সায় দিলে ডেমু সচলে কাজ করতে চাই।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমি নিশ্চয়তা দিতে চাই যে, সচল করে এই ডেমু টানা ১৫ থেকে ২০ বছর চালানো সম্ভব।’

এদিকে ডেমু ট্রেন সচল করতে অনেক প্রতিষ্ঠানই রেলওয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বলে জানা গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রেল ভবনে এক বৈঠকও হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেমু নিয়ে অনেক কাদা ছোড়াছুড়ি হয়েছে, এখনো হচ্ছে। মিডিয়ায় প্রায়ই খবর হচ্ছে। তাই ডেমু সচলের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আগ্রহী নন। কারণ এটাতে টাকা খরচ হবে, সচল না হলে দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে।

তিনি আরও বলেন, ‘ডেমু মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করার প্রস্তাব পাওয়া যাচ্ছে। তবে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা এলে হয়তো উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। তবে রেলওয়ে নিজেরা কোনো উদ্যোগ নেবে না।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেমু সাধারণ কোনো ট্রেন নয়, পুরোটাই প্রযুক্তিনির্ভর। এখানে সফটওয়্যার আছে, হার্ডওয়্যার আছে। কিন্তু এর কারিগরি জ্ঞান ও মেরামতের প্লাটফর্ম নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এভাবে জোড়াতালি দিয়ে মনে হয় না টেকসই কিছু হবে। প্রথম থেকে যদি এই প্রকৌশলীদের রাখা হতো তাহলে ভালো হতো। যদিও বাংলাদেশে এমনটা হয় না কখনো। কারণ, এই জায়গাতে দুর্বলতা রয়েছে।’ শামসুল হক বলেন, ‘ডেমু কেনার ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত রেলওয়ে নিয়েছিল- এমন ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে।’

উল্লেখ্য, গত ১৪ বছরে রেলের উন্নয়নে খরচ হয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। অথচ এখনো বছরে লোকসান দুই হাজার কোটি টাকা।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

অনীহা কর্মকর্তা ডেমু ট্রেন প্রকৌশলী রেলওয়ে সচল

বিজ্ঞাপন

মেলার ৬ষ্ঠ দিনে নতুন বই এসেছে ৮০টি
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:৪৫

খুলনায় শেখ হাসিনার গোডাউন ভাঙচুর
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:২৭

আরো

সম্পর্কিত খবর