Wednesday 12 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যশোর সালতাপীরের ঢিবি
বিশাল এলাকা জুড়ে মাটি চাপা রাজপ্রাসাদ!

তহীদ মনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:০৮

সালতাপীরের ঢিবি। ছবি: সারাবাংলা।

যশোর: যশোর সদর উপজেলার কাসিমপুর ইউনিয়নের সালতাপীরের ঢিবিতে খনন শুরু করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। ৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া প্রাথমিক খননে একটি রাজপ্রাসাদের আবিস্কারের অপেক্ষায় রয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনুমান ৫০ বিঘা ভূমি জুড়ে রাজপ্রাসাদ চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে।

এখানে শানবাঁধানো ঘটলা ও সীমানাপ্রাচীরের অস্তিত্ব স্পষ্ট। পুরো সীমানার মাঝ বরাবর একটি উচু ঢিবি রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে এটি সালতাপীরের ঢিবি বা বুড়িমার থান নামে পরিচিত।

বিজ্ঞাপন

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ১০ দিন খনন করে মসজিদ আকৃতির একটি স্থাপনার সন্ধান পেয়েছেন। স্থানটি মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন বলে অনুমান করছেন গবেষক দলের প্রধান লাভলী ইয়াসমিন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, প্রাথমিক খননে দেওয়াল দেখা গেছে। যা প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার সঙ্গে নতুনত্ব রয়েছে। এতে যশোরের ইতিহাস নতুন করে গবেষণা ও ভাববার সময় এসেছে।

যশোর-মাগুরা সড়কের রাজাপুর বাজার থেকে পশ্চিমের পাকা রাস্তা ধরে ৩ কিলোমিটার গেলেই ফুলবাড়ি পীর সিদ্দিন আওলীয়া মাজার ও স্কুল। সেখান থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই ওসমানপুর গ্রাম। এ গ্রাম লাগুয়া সালতা মাঠ। চারিদিকে ফসলি জমির মাঝে প্রায় ৫০বিঘা উঁচু ভূমি। কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও ফলদ, কোথাও বনজ বাগান। উঁচু ভূমির মধ্যে ঘন জঙ্গল বেষ্টিত সবচেয়ে উঁচু ভূমিই সালতা পীরের ঢিবি। স্থানীয়রা যাকে বুড়িমার থান বা ‘বুড়োমার দরগা’ বলে থাকেন।

দীর্ঘ বছর ধরে এ থানে মানত করে, ধুপ জালায় স্থানীয় বাসিন্দারা। খায়রুল নামের এক ব্যক্তি এ দরগার খাদেমের দায়িত্বও পালন করেন। তবে থান বা বুড়ি মার বিষয়ে কেউ কিছুই জানেন না। বতর্মানে যারা ওই এলাকায় বসবাস করছেন, যাদের বষস ৭০-৮০ বছর তারাও বলছেন তাদের বাবা-দাদারাও কিছু জানতেন না।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়দের বিশ্বাস করেন, বুড়িমার থান ও দেড় কিলোমিটার দূরের পর ফুলবাড়ি বাজারের দীঘি ও হযরত সিদ্দীন আউলিয়া (র) এর মাজার একই সূত্রে গাথা। সিদ্দীন আউলিয়া ওই বুড়ি মায়ের ছেলে। বাগেরহাটের পীর আউলিয়া খানজাহান আলী(র) এই এলাকায় যখন এসেছিলেন, হযরত সিদ্দীন (র) সেই সময় এসেছিলেন। জ্বীন পরীরা এখানকার দীঘি খনন করেন। এ বিশ্বাস থেকেই জঙ্গল ঘেরা ঢিবিতে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলে, মানত করে, ধূপ-ধুনা দেয়, মুরগি-খাসি ছেড়ে দিয়ে মানত শোধও কেউ কেউ। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মর মানুষ গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা সেখানে মিলিত হন।

ঢিবি সংলগ্ন উঁচু ভিটার কয়েক বিঘা জমির মালিক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আকবার আলী খান। তিনি জানান, নানাবাড়ির সম্পত্তির ওয়ারিশ সূত্রে ওই জমির মালিক তিনি। ওই স্থান ভয়ের জায়গা ছিল। মানত-পূজা, রান্না সবই হয় এ দরগায়। বালামুসিবত এলে অনেকেই রাতজেগে জিকির-আসগর করেন। জমিতে গাছ লাগাতে যেয়ে ইটের টুকরো পান। কয়েকবছর আগে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটি সরিয়ে ঘরের ভিত্তি বা দেওয়ালের মতো কিছু পেয়েছিলেন, লোকে নিষেধ করায় আর খনন করেননি।

তিনি প্রচিলত কয়েকটি উপকথাও শুনিয়ে জানান, এ জমির কিছু কেউ নিয়ে গেলে তার বিপদ হতো। মানুষের ভিতর এক ধরণের ভয় কাজ করতো।

তার জ্ঞাতিভাই ষাটোর্ধ্ব কৃষক আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিনি এটি মসজিদ কিনা দেখার জন্যে গড়ের পশ্চিম দিকে লম্বা করে খনন কাজ করেছিলেন, স্থানীয়রা তাকে বিভিন্ন প্রকার ভয় দেখায় এবং তাদের চাপে তিনি খনন বন্ধ করেন।

গ্রামের ৬৩ বছরের আক্তারুজ্জামান খানও একই রকম কথা শোনান। তারা কেউ এর ইতিহাস জানেন না, পূর্ব পরুষের কাছে বংশানুক্রমে বিভিন্ন কথা ও কাহিনী শুনেছেন আর মানুষকে বিশ্বাস ও ভক্তি করতে দেখেছেন। হিন্দু মুসলিম সবাই এখানে আসেন, সম্মান করেন।

যশোর জেলার চতুর্থ প্রত্নঢিবি হিসেবে সদর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের সালতা গ্রামের সালতাপীরের ঢিবিতে ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে পরীক্ষামূলক খনন কাজ শুরু হয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক দফতরের পরিচালক লাভলী ইয়াসমিনের নেতৃত্বে গঠিত ৮ সদস্য বিশিষ্ট অভিজ্ঞ খননটিম খননকাজ পরিচালনা শেষে প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত নমুনা নিয়ে গবেষণা করবেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়মানুসারে গবেষণা শেষে এটা কোন আমলের স্থাপনা, কোন সভ্যতা বা যুগের সঙ্গে সম্পর্কত সে সব বিষয় অনুসন্ধান ও গবেষণার ফল জানাবেন। সরকারিভাবে খনন কাজ হচ্ছে বলে প্রতিদিন সালতা ওসমানপুরসহ আশে পাশের গ্রাম থেকে মানুষ ভিড় করছেন।

২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে যশোর সদর উপজেলায় পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের সময় এ এলাকায় মাঝারি আকৃতির উচ্চতা বিশিষ্ট ঢিবিটি সনাক্ত হয়। প্রাথমিকভাবে ৫ থেকে ১০ দিনের খনন করার সিদ্ধান্ত হয়।

১৯৬৮ সালের প্রত্নসম্পদ আইন অনুযায়ী এর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব পরিলক্ষিত হওয়ায় ঢিবিটিকে জরিপ তালিকায় অন্তভূক্ত করে সংশ্লিষ্টরা অধিদফতর।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন জানান, প্রাথমিক ভাবে ঢিবির নীচে আদি ঐতিহাসিক থেকে আদি মধ্যযুগের বিলুপ্ত সাংস্কৃতিক নিদর্শন লুকায়িত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটা মুসলিম সভ্যতার একটি নিদর্শন।

তিনি মনে করেন, এটা ছিল কোনো শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল, পুরাতন কোনো সভ্যতার অংশ। তবে গবেষণা শেষে এর উত্তর মিলবে জানিয়ে তিনি নিশ্চিত করেন যে, স্থাপনাটি মুসলিমদের। যেহেতু ফুলবাড়ি বাজারের দীঘিটি ও পাশের মাজার রয়েছে, হতে পারে এই কেন্দ্রের রাজত্ব এর চারিপাশে বিস্তৃতি ছিল।

সারাবাংলা/এসআর

ঢিবি মাটি চাপা রাজপ্রাসাদ যশোর রাজপ্রাসাদ সালতাপীরের ঢিবি