নিজের বই ফেরি করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কোহিনুর, চালান হাসপাতাল
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:১০ | আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:৪৩
ঢাকা: সুন্দর এ পৃথিবীটার রূপ দেখে আমরা কতই না মুগ্ধ হই। কত কবি কত শত কবিতা লিখেছে এ অপরূপ প্রকৃতি নিয়ে। এর সবই সম্ভব হচ্ছে আমাদের চোখে আলো আছে তাই। কিন্তু যার চোখে আলো নেই, তাদের জীবনও তো থেমে থাকে না। প্রজ্ঞার শক্তি পৃথিবীর সবকিছুকে জয় করতে পারে তাই দেখিয়েছে জ্ঞানপিয়াসী অদম্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা। চোখের আলো যাদের নেই তারা নিজেদের আলোতেই নিজেদের জ্ঞানের আলোর শিখা ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। ইংরেজ কবি জন মিলটন, গ্রিক কবি হোমার, ফারসি কবি রুদাকি ও হেলেন কিলার, আরবি সাহিত্যের খ্যাতনামা কবি বাশশার বিন বোরদসহ অনেক বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। এ প্রতিব্ধকতা তাদের সাফল্যের পথে বাধা হতে পারেনি। তেমনি অদম্য কবির দেখার মিললো অমর একুশে বইমেলায়।
কোহিনুর আক্তার জুঁই—কবি ও সাহিত্যিক। মেলায় ঘুরে ঘুরে নিজের লেখা বই বিক্রি করেন। লেখিকার ডাকনাম যে ফুলের নামে সে ফুলের সুগন্ধ সবার মন কাড়ে। কিন্তু নিজেকে বিকশিত করার আগেই দৃষ্টিশক্তি হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। জানালেন, বসন্ত রোগে পুরো হাতের চামড়া যেমন নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি দুই চোখের আলোও কেড়ে নেয়।
অদম্য এ লেখিকা দমে যাওয়ার পাত্রী নন। ১৯৭৭ সালে দেশের প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের স্কুল এসডব্লিউআইডি-তে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। স্কুলটি প্রথম যে পাঁচজনকে নিয়ে শুরু হয়, তাদের মধ্যে উনি একজন। ১৯৮৬ সালে ওই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। এরপর মাস্টার্স সম্পন্ন করার পাশাপাশি জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র থেকে বিএ (বিএড) করেছেন।
খাতায় মনের আনন্দে কবিতা লিখতেন। নিজের লেখা কবিতা নিজেই পড়তে পারতেন না বলে বেশিরভাগ সময় খাতার পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে ফেলতেন। কোহিনুরের ভাষ্যে, ‘আমি ক্লাশ থ্রি থেকে লিখতাম, বন্ধু-বান্ধবকে দেখাতাম। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় খাতা ছিঁড়তে দেখা আমার এক বান্ধবী বললো, এটা ছিড়লা কেন? এটা তো অনেক সুন্দর কবিতা। তুমি কিন্তু অনেকগুলো জমিয়ে বই করতে পারো।’
বান্ধবীর সে কথার জবাবে ছোট্ট কোহিনুর হেসেছিলেন। জবাবে বলেছিলেন, ‘আমি তো অন্ধ মানুষ, আমার বই কিনবে কে?’ তার এ প্রশ্নের উত্তরে বান্ধবী যা বলেছিলো তা এখনো মনে আছে তার—‘তুমি অন্ধ, তোমার লেখাতো অন্ধ না। আমার অনুরোধ থাকলো বই করার।’
এরপর দেখতে দেখতে অনেক বছর চলে গেল। ২০০৫ সালে ‘উপহার’ দিয়ে শুরু। সে বইটি ৬ হাজার কপি ছাপিয়েছিলেন। বিক্রি করেছিলেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজে। ২০১৯ থেকে বই মেলায় নিয়মিত নিজের বই নিয়ে আসেন। ‘তখন আমার প্রকাশনা সংস্থা ছিল না, তাই বিভিন্ন স্টলে বিক্রির চেষ্টা করেছি। কেউ আমার বই নেয়নি। অবশেষে আমার নিজের নামে কোহিনূর বই প্রকাশনী খুলেছি। তারপর থেকে প্রতি বছর মেলায় হেঁটে হেঁটে বই বিক্রি করি’,—বলেন কোহিনুর।

কোহিনুরের লেখা বই দেখছেন পাঠক। ছবি: সারাবাংলা
স্টলগুলো যখন তার বই নিচ্ছিলো না তখন নিজ উদ্যোগেই প্রকাশনা সংস্থাটি করেছিলেন। এটি করে কি আপনি সফল? ঝটপট জবাব, ‘আমি অবশ্যই সফল হয়েছি।’
তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৩। এ বছর তার লেখা ৩টি বই আসছে। সুখ, সাগরে ভাসা সোহেল, প্রজাপতির খেলা, অদৃশ্য কাবা শরীফ—তার লেখা কয়েকটি বইয়ের নাম।
১৯৯২ সালে তিনি অন্ধ মহিলা সংস্থা নামক সংগঠন করেন। ২০০৩ সালে করেন কোহিনুর চক্ষু হাসপাতাল। দুটি প্রতিষ্ঠানের সভানেত্রী ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। বই বিক্রি থেকে লব্ধ অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো চলে। ২০২২ এ ৪০ হাজার, গত বছর ৩৫ হাজার টাকার বই বিক্রি করেছেন। পুরো টাকাটা চক্ষু হাসপাতালে ব্যয় করেন।
হাসপাতালটি ঢাকার অদূরে সাভারের ধলপুরে নিজস্ব জমিতে অবস্থিত। শুরু করেছিলেন ভাড়া বাড়িতে টিনের ঘর দিয়ে। বর্তমানে সরকার থেকে পাওয়া জমিতে এর কার্যক্রম চলছে। মাত্র ৩০ টাকা ভিজিটে ডাক্তার রোগী দেখেন। একজন ডাক্তার প্রতি শনিবার হাসপাতালে বসেন। মাঝে মধ্যে তারা বিনামূল্যে চক্ষু ক্যাম্প পরিচালনা করেন। অর্থাভাবে এখানে রোগী ভর্তির জন্য শয্যা নেই।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যক্তি ও সরকারী সহায়তায় হাসপাতালটি চালাচ্ছি। বই বিক্রি ছাড়াও আমি সেলাইয়ের কাজ শিখাই। সেখানের আয়ও এখানে ব্যয় হয়। ইচ্ছে আছে সাহায্য সহযোগীতা পেলে এতে দন্ত, নাক-কান গলা, আয়ূবের্দীক বিভাগও চালুর।‘

কোহিনুরের লেখা কিছু বই। ছবি: সারাবাংলা
বিএ পাশ করার পর পরই বিয়ে হয়েছিল কোহিনূরের। কিন্তু স্বামী বিদেশে যাওয়ার পর আর ফেরেননি। অভমানী কণ্ঠে কোহিনুর বলেন, ‘বিয়ে করার পরে উনি সৌদি আরব চলে যান। এরপর আর আসেননি। আমাদের সংসারটা আর হয়নি।’
বাবা-মাকে হারিয়েছেন বহু আগে। তারা দুই ভাই, দুই বোন। বর্তমানে তার সঙ্গে ছোট বোন ও বোনের সন্তান থাকে। হাসপাতালটির একটি রুমেই থাকেন।
বইগুলো বিভিন্ন জনকে দিয়ে লেখান। তিনি মুখে বলেন, আরেকজন লিখেন। এ জন্য কেউ এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেননি। ব্রেইল পদ্ধতিরও আশ্রয় নেন না। তবে এ বছর একজন মহিলা নিয়েছেন ৫ হাজার টাকা বেতন দিয়ে। তিনি তার অফিসে কাজ করার পাশাপাশি সময় পেলে তাকে বই লেখায় সহায়তা করেন।
প্রতি বছর বইমেলার শুরু থেকেই থাকেন। তবে এ বছর মেলায় এসেছেন ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে। জানালেন, ১৫ দিন অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি। ব্যাথায় পা ফুলে গিয়েছিল। ঠিকঠাক হাঁটতে পারছেন না ব্যাথার কারণে। ‘তারপরও মন মানে না কখন বই মেলায় যাবো। আমার প্রিয় বই মেলা’,—স্মিত হেসে বলেন কোহিনুর।
একজন ভালো লেখক হতে চান কোহিনুর। আর চান হাসপাতালের মাধ্যমে মানবসেবা করে যেতে। এর জন্য সকলের সহযোগিতা চান তিনি।
সারাবাংলা/এজেডএস