ত্রিভুজ প্রেমের বলি, যেভাবে খুন হয় তাজকির
১৭ মার্চ ২০২৫ ১৭:০৫ | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৫ ১৮:২২
খুলনা: খুলনার আলোচিত তাজকির আহমেদকে হত্যার রহস্য উন্মোচন করেছে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি)। সোমবার (১৭ মার্চ) সকালে কেএমপির সংবাদ সম্মেলনে হত্যার মূলরহস্যের বিস্তারিত জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ আসিফ মাহমুদ খালিশপুর থানায় তার মামাতো ভাই তাজকির আহম্মেদ নিখোঁজ হয়েছে মর্মে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। যার জিডি নম্বর-১১৫৪। এই ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য খালিশপুর থানা পুলিশের একটি চৌকস তদন্ত টিম প্রস্তুত করা হয়। ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পারে প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে প্রেমিকার ব্যবহৃত হোয়াটস্অ্যাপ থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে ভিকটিম তাজকির তার চাচাতো ভাই রনির শ্যালিকা সীমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢাকা থেকে খুলনা আসেন।
তাজকির আহমেদ গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খালিশপুর থানাধীন গোয়ালখালি এলাকায় তার মামাতো ভাই আসিফ মাহমুদের বাড়িতে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য আসে এবং বাসাতে কিছু সময় থেকে প্রেমিকা সীমার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে নিখোঁজ হন। এই ঘটনায় পরবর্তীতে নিখোঁজ যুবকের পিতা মুরাদ হোসেন বাদী হয়ে এজাহারনামীয় ৫ জনসহ অজ্ঞাতনামা আরও ২-৩ জন আসামির বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করলে খালিশপুর থানার মামলা নম্বর-২২, ধারা-৩৬৫/৩৪ পেনাল কোড রুজু করা হয়। তৎপ্রেক্ষিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশ এজাহারনামীয় আসামি সুরাইয়া আক্তার সীমা (২০), লাবনী বেগম (৪২) ও শহিদুল ইসলাম সাহিদকে (২০) গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করে।
মামলা তদন্তকালে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি খালিশপুর থানা পুলিশ খানজাহানআলী থানাধীন ভৈরব নদীর বালুর মাঠ ঘাটে বস্তা বন্দি একজন অজ্ঞাতনামা যুবকের মরদেহ পড়ে আছে মর্মে সন্ধান পায়। পুলিশের অনুরোধে জিডির বাদী আসিফ মাহমুদসহ ভিকটিমের পিতা এবং তাদের নিকট আত্নীয়রা খুলনা মেডিকেল হাসপাতাল মর্গে উপস্থিত হয়ে মরদেহের শরীরে পরিহিত চেক শাট ও পরনের প্যান্ট দেখে অজ্ঞাতনামা মরদেহটি ভিকটিম তাজকির আহম্মেদের বলে সনাক্ত করেন। পুলিশের চৌকস তদন্ত টিম গ্রেফতারকৃত আসামিদের নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ, নিরবিচ্ছিন্ন তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রযুক্তির সহযোগিতায় অল্প সময়ের মধ্যে মামলার রহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হয়।
তদন্তে জানা যায় যে, প্রেমিকা সীমা সম্পর্কে ভিকটিমের ভাইয়ের শ্যালিকা। সীমার এজাহারনামীয় ১ নম্বর আসামি ইসমাইল হোসেন অভির সঙ্গে তিন বছর পূর্বে তাদের পরিবারের অমতে বিয়ে হয়। পরবর্তীতে অল্পদিনের মধ্যে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায় এবং অভি দেশের বাইরে চলে যায়। এই সুযোগে তাজকির আহম্মেদ এর সঙ্গে সীমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ডিভোর্সের ৭-৮ মাস পরে অভি দেশে ফিরে এসে প্রাক্তন স্ত্রী সীমার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাদের মধ্যে পুনরায় সম্পর্ক তৈরি হয়। এ সময়ে ত্রিভূজ প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয় যা একমাত্র সীমা জানত। সীমা একই সঙ্গে দুটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দুই প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক চলমান রাখে যাতে কেউই বিষয়টি বুঝতে না পারে। এদিকে অভি আর সীমার পুনঃ সম্পর্কের বিষয়টি তাদের উভয় পরিবারের লোকজন জানলেও তাজকিরের সঙ্গে প্রেমের বিষয়টি অপ্রকাশ্যে থেকে যায়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, কিন্তু ঘটনা পরিক্রমায় অভি সীমার সঙ্গে তাজকিরের প্রেমের সম্পর্কের কথা জেনে যায়। এটা নিয়ে সীমা এবং অভির মধ্যে ঝগড়া হতে থাকে। অভি ভিকটিম তাজকিরকে শায়েস্তা করার জন্য সীমার ব্যবহৃত গোপন মোবাইল ফোন থেকে হোয়াটস্অ্যাপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভিকটিমকে খুলনায় আসতে বলে। তাজকির খুলনা আসলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অভি তার বন্ধুদের সহায়তায় তাকে অপহরণ করে নিজ বাসায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে অভিসহ ৪ বন্ধু মিলে তাজকিরের হাত-পা বেঁধে মুখে কচটেপ পেচিঁয়ে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে ও পুরুষাঙ্গে উপর্যুপরি আঘাত করে, গলায় রশি দিয়ে ফাঁস দিয়ে নৃশংসভাবে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরবর্তীতে তারা ৪ বন্ধু মিলে ডাকবাংলা থেকে ১০০ টাকা দিয়ে বস্তা ক্রয় করে তাজকিরের লাশ বস্তায় ভরে ইজিবাইকে করে ভোর রাতে ৪-৫ টার দিকে হার্ডবোর্ড খেয়াঘাটে নিয়ে যায়। সেখান থেকে পূর্বে ভাড়া করে রাখা ট্রলারযোগে দৌলতপুর যাওয়ার দিকে নদীর মাঝখানে নিয়ে লাশ ফেলে দেয়।
চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত অপর দুই আসামি মশিউর রহমান জিতু (২৪), রিয়াদ কাজীকে (২২) গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে সৌপর্দ করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামি জিতু এবং রিয়াদ তাজকির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বিজ্ঞ আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে। হত্যাকাণ্ডের পর মরদেহ বহনের কাজে ব্যবহৃত ইজিবাইকের চালক শহিদুল ইসলাম সাহিদকেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে। থানার রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আরও কোন মামলা আছে কিনা তা যাচাই করা হচ্ছে। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত আছে।
সারাবাংলা/এইচআই