চাষিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ
৭০ শতাংশ আলু রাখার হিমাগার নেই
২০ মার্চ ২০২৫ ১০:০০ | আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৫ ০৩:৩৫
রংপুর: গেল মৌসুমে বাজারে আলুর দামবৃদ্ধিতে রংপুরের পীরগঞ্জের কৃষক মিজানুর রহমান এবার অন্যান্য ফসল চাষ না করে কেবল আলু চাষ করেছেন। হয়েছে আলুর বাম্পার ফলন। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ফলন হওয়ায় স্বপ্ন দেখেছেন গত কয়েক বছরের লোকসান কাটিয়ে উঠার, ঋণ শোধ করার। কিন্তু সব আশায় যেন গুড়েবালি।
ঝুঁকি নিয়ে আলু চাষ করে মিজানুর রহমান এখন চরম বিপাকে। কারণ জমির ইজারা ও বীজ আলুর দাম বেশি হওয়ায় আলু উৎপাদনে প্রতি কেজিতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ২০ টাকা। এখন আলুর দাম ১৩ থেকে ১৪ টাকা। এ সময় আলু বিক্রি করলে লোকসানে পড়বেন। এদিকে, নেই আলু সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। হতাশ তিনি।
মিজানুর রহমানের মতই একই অবস্থা এখানকার আলু চাষিদের। তারা হিমাগারের অভাবে আলু নিয়ে বিপাকে রয়েছেন।
চলতি মৌসুমে রংপুরে আলু আবাদ ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ছাড়িয়ে গেছে। উৎপাদিত আলুর মাত্র ৩০ শতাংশ হিমাগারে সংরক্ষণ করা গেলেও ৭০ শতাংশ আলু রাখার হিমাগার নেই। যে কারণে আলু চাষিদের দুশ্চিন্তা।
এদিকে, হিমাগারেও রাখতে পারছেন না আলু। হিমাগার মালিক কেজিপ্রতি ভাড়া বৃদ্ধির করার কারণে এমন পরিস্থিতি। এখন আলু নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছেন তিনি। চলতি মৌসুমে আলু চাষ করে উত্তরাঞ্চলের লাখো কৃষকের অবস্থা এখন মিজানুর রহমানের মতো।
মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দের আলুচাষি রুস্তম আলী বলেন, ‘৫ একর জমিতে আলু চাষ করে বিপাকে পড়ে গিয়েছি। উৎপাদিত আলুর ৩০ শতাংশ হিমাগারে রাখতে পেরেছি; বাকি আলু নিয়ে এখন দুশ্চিন্তা।’
রংপুর হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বাবলু জানান, ২০২১ সালে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে ভাড়া ছিল ৫ টাকা। ২০২২ সালে সাড়ে ৫ টাকা, ২০২৩ সালে ৬ টাকা এবং গত বছর ৭ টাকা ছিল। গত বছরের তুলনায় কেজিতে ১ টাকা বাড়িয়ে এবার হিমাগার ভাড়া ৮ টাকা করা হয়েছে।
কৃষকদের দাবি, আগে আলু রাখা হতো বস্তা হিসেবে, কেজি হিসেবে নয়। এবার বস্তা হিসেবে রাখতে দিচ্ছে না হিমাগার। আগে প্রতি বস্তা ভাড়া ছিল ৩২০-৩৫০ টাকা। এক বস্তায় ৭০ থেকে ৮০ কেজি পর্যন্ত রাখা যেত। এবার প্রতি বস্তায় ৫০ কেজির বেশি রাখা যাবে না। ভাড়া পড়বে ৮ টাকা হিসেবে ৪০০ টাকা। এতে কৃষককে বাড়তি টাকা গুনতে হবে। ক্ষতির মুখে পড়বেন তারা।
তবে কৃষকের দাবি মানতে নারাজ বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী। তার দাবি সব সময় হিমাগারের ভাড়া কেজিতে নির্ধারিত ছিল, বস্তাপ্রতি নয়। সংরক্ষণকারীরা এটা মানতেন না। তারা প্রতি বস্তায় ২০ থেকে ৩০ কেজি বাড়তি আলু রাখতেন। এতে কৃষকের লাভ হলেও লোকসান হতো হিমাগার মালিকের। তাই এবার তারা কঠোর হয়েছেন।
বাংলাদেশ খেতমজুর ও কৃষক সংগঠনের আহ্বায়ক আহসানুল আরেফিন তিতু বলেন, ‘জেলায় উৎপাদিত দুই-তৃতীয়াংশ আলু সংরক্ষণের হিমাগার না থাকায় অধিকাংশ আলু উৎপাদন মৌসুমে কম দামে তারা বিক্রি করতে বাধ্য হন। উৎপাদন মৌসুমে সরবরাহ বেশি থাকায় কৃষক ন্যায্য দাম পান না। এতে কৃষকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
কৃষি বিভাগ জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রংপুরে ৫৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে ১৩ লাখ ৪ হাজার ৩১৭ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়, যা সারা দেশের জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৩ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয় ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৫৭৬ মেট্রিক টন। এবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৩ হাজার ৯৫০ হেক্টরে। কিন্তু আবাদ হয়েছে ৬৬ হাজার ২৮০ হেক্টরে। সম্ভাব্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৭৫ হাজার ৭২৪ মেট্রিক টন।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, রংপুরে আলুচাষি সংখ্যা ১ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ জন। একটি সরকারিসহ জেলায় ৪০টি আলুর হিমাগার আছে। এসব হিমাগারে ৪ লাখ ১৬ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন আলু রাখার সুযোগ আছে। এর বাইরে কৃষি বিপণন অধিদফতরের ১২১টি অহিমায়িত আলুর মডেল ঘর করা হয়েছে। এসব অহিমায়িত ঘরে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত আলু সংরক্ষণ করা যাবে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, একসময় মুন্সিগঞ্জ আলু উৎপাদনে শীর্ষ জেলা থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রংপুরে সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হচ্ছে। দেশের মোট আলুর ১৫ শতাংশ উৎপাদন হচ্ছে রংপুরে।
রংপুর কৃষি বিপণন অধিদফতরের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা শাকিল আখতার জানান, ‘সব মিলিয়ে ৩০ শতাংশ আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করা যাবে।’
সারাবাংলা/এসআর
আলু নিয়ে বিপাকে চাষিদের দুশ্চিন্তা বাম্পার ফলন রংপুর সারাবাংলা হিমাগার নেই