জামগ্রামেই কাগজের ‘ফুল ফোটে’
১১ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:১০
নওগাঁ: আর মাত্র কয়েকদিন পরে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বরণ করা হবে নতুন বাংলা বছর। নতুন বছর ঘিরে চলছে নানা আয়োজন। বসবে মেলা। এ মেলায় ‘প্রধান আকর্ষণ’ কাগজের ফুল। নওগাঁর আত্রা উপজেলার জামগ্রামে তৈরি হওয়া কাগজের ফুল দেশ সেরা। এখানকার ফুল কারিগরদের দাবি দেশে একমাত্র তারাই কাগজের ফুল তৈরি করেন, জামগ্রামেই কাগজের ‘ফুল ফোটে’।
প্রহেলা বৈশাখে কাগজের বাহারী ফুল ছাড়া যেন পূর্ণতা পায় না। বৈশাখী মেলাও জমে উঠে না। যে কারণে বৈশাখ এলেই ব্যস্ত হয়ে উঠেন জামগ্রামের ফুল কারিগররা।
প্রিয়জনকে উপহার, ছোট্ট সোনামুনিদের খেলনা কাগজের ফুলের কোনো তুলনা হয় না। উৎসব-আনন্দে কাগজের ফুলের যোগান দিতে দিন-রাত নানান রঙের বাহারি কাগজ দিয়ে ফুল তৈরি করতে ব্যস্ত জামগ্রামের ফুল কারিগররা।
আসছে ১৪ এপ্রিল সামনে রেখে স্টার, চর্কি, মানিক চাঁদ, গোলাপ, সূর্যমুখী, কিরণমালা, জবা, গাঁদাসহ বাহারী ফুল তৈরি করছেন। কারিগরদের বিরামহীন ব্যস্ততায় তৈরি হওয়া কাগজের ফুলে বৈশাখী আনন্দে ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে।

কাগজের ফুল
প্রায় ৪০ বছর আগে ওই গ্রামের দু’চারটি হিন্দু পরিবার ফুল তৈরির কাজ শুরু করেন। তাদের হাত ধরে পুরো গ্রামে মানুষ পেশা হিসাবে নিয়েছেন এই ফুল তৈরির কাজ। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের প্রধান আয়ের উৎস এই ফুল তৈরি। বর্তমানে প্রায় ৪শ’ পরিবার কাগজ দিয়ে বাহারি ফুল ফোটান।
সংসার দেখভাল করার পাশাপাশি গ্রামের নারী-পুরুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, ছোট-বড় সবাই ফুল তৈরি করার কাজ করে থাকেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবে বৈশাখী মেলা আর এই মেলাগুলোকে আরও বর্ণিল সাজে সাজাতে তাদের এই প্রাণান্তর চেষ্টা। আর তাই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে রাত অবধি কাজ করে যাচ্ছেন ফুল তৈরির কারিগররা।
ফুল তৈরির পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে কাগজের ফুল বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। তবে পহেলা বৈশাখে এই ফুলের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। তবে দুই ঈদে, বিভিন্ন পূজা ও মেলায়ও এই ফুল বিক্রি করা হয়। কেউবা কাপড়, কাগজ আর বাঁশসহ নানা উপকরণ দিয়ে সকাল থেকে রাত অবধি ফুল তৈরির কাজ করে চলেছেন।
বিশেষ করে বাড়ির নারীরা সংসারের কাজ শেষ করে তৈরি করছেন এসব বাহারী ফুল। খুব বেশি পরিশ্রম না হলেও ধৈর্য নিয়ে করতে হয় কাগজের ফুল তৈরির কাজ। বাড়ির সবাই মিলে ফুল তৈরির পর পুরুষরা বিক্রির উদ্দেশ্যে চলে যায় জেলা ও জেলার বাহিরে। এখানকার ফুল দেশের ৬৪ জেলাতে বিক্রি হয়।
জামগ্রামের ফুল কারিগর দুলু বলেন, তার দাদা পর বাবা কাগজের ফুল তৈরি ও বিক্রি করতেন। গত ২০ বছর ধরে তিনি এ পেশার সঙ্গে আছেন।
তিনি আরও বলেন, এসব ফুল তৈরির উপকরণ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আমদানি করা হয়। তারপর সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে ফুলে রূপান্তরিত করা হয়। এই ফুল তৈরির কাজে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান সহযোগিতা করে থাকেন। পহেলা বৈশাখ আসার এক মাস আগে থেকে শুরু হয় এসব ফুল তৈরির কাজ।
ওই গ্রামের ফুলের কারিগর মনিরুল ইসলাম কানন বলেন, তার বাবা এই ফুল তৈরি ও তৈরিকৃত ফুল বিভিন্ন জেলায় পাইকারি বিক্রি করতেন। এখন ফুল বিক্রির আয় থেকে তার সংসার চলে।
আমিনুল ইসলাম বলেন, কৈশোরকাল থেকেই তিনি এই ফুল বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তিনি পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বসা বৈশাখী মেলাতে বিক্রি করে করতে নিয়ে যান কাগজের ফুল।
ফুলের কারিগর আফরোজা বানু বলেন, ফুল তৈরিতে পরিবারের গৃহিণীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। সংসারের কাজ শেষ করে ফুল তৈরিতে সহযোগিতা করে আসছি।
তিনি আরও বলেন, বিনা সুদে অথবা স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা থাকলে এ শিল্পটি আরও এগিয়ে যাবে।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, এটি একটি ঐতিহ্যপূর্ণ শিল্প। যার কদর দেশজুড়ে। সৌখিন মানুষ ও শিশুদের কাছে বাহারি কৃত্রিম ফুলগুলোর চাহিদা অনেক বেশি। ফুল কারিগররা শুধু তাদের উপার্জনই নয়; বাংলার সকল সাংস্কৃতিক উৎসবকে বর্ণিল করতেও বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছেন। এটা একটি ক্ষুদ্র কুটির শিল্প। আর এই শিল্পের তৈরি ফুলগুলি দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিক্রি হচ্ছে। শুধু পহেলা বৈশাখ নয়, বিভিন্ন গ্রামীণ মেলার সৌন্দর্যবর্ধনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে জামগ্রামের ফুল। এর সঙ্গে জড়িত কারিগরদের জন্য উন্নতমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাসহ স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক।
সারাবাংলা/এসআর