বিজিএমইএ নির্বাচন থেকে বাদ ৬৩২ ভুয়া ভোটার
২৩ এপ্রিল ২০২৫ ২২:০৪ | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:০১
ঢাকা: দেশের পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতনিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ২০২৫-২০২৭ মেয়াদের পরিচলনা পর্ষদের নির্বাচনের আগে ভুয়া ভোটার বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচনের চেয়ে এবার ভোটার কমেছে ৬৩২ জন। ২০২৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ২ হাজার ৪৯৬ জন ভোটার থাকলেও এবারের নির্বাচনের আগে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৬৪ জনে।
এদিকে এবারের নির্বাচন বিজিএমইএ’র নিজস্ব ভবনে অনুষ্ঠিত না হয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু হোটেলে অনুষ্ঠিত হবে। ২৮ মে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন নির্বাচন কেন্দ্রিক দুই জোট ফোরাম ও সম্মিলিত পরিষদের নেতারা। এরই মধ্যে দুই প্যানেলেরই দলনেতা ঘেষণা করা হয়েছে। ঢাকায় এখনো প্যানেলের ঘোষণা না দিলেও চট্টগ্রামে সম্মিলিত পরিষদের প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে। শিগগিরই উভয় অঞ্চলের জন্য ফোরামের প্যানেল ঘোষণার কথা রয়েছে। বিজিএমইএ’র বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিজিএমইএ’র ২০২৫-২০২৭ মেয়াদের পরিচলনা পর্ষদের ৩৫টি পরিচালক পদে এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গেল ৮ মার্চ এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। গেল ২২ এপ্রিল চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ হয়েছে। বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন নির্বাচনে ভোটার ১ হাজার ৮৬৪ জন। এর মধ্যে ঢাকার ভোটার ১ হাজার ৫৬১ এবং চট্টগ্রামের ভোটার ৩০৩ জন।
তথ্যমতে, সর্বশেষ নির্বাচনে বিজিএমইএ’র ভোটার ছিল ২ হাজার ৪৯৬ জন। এর মধ্যে ঢাকা অঞ্চলের ভোটার ছিল ২ হাজার ৩২ জন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৪৬৪ জন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলে সংগঠনটিতে প্রশাসক নিয়োগের পর যাচাই-বাছাইয়ে ৬৯০ জন ভুয়া ভোটার বা অচল কারখানার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় বাদ পড়া ভোটারের সংখ্যা কিছুটা কমেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমইএ’র একপক্ষের শীর্ষ এক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওই নির্বাচনে আমরা প্রায় ৭০০ জন ভুয়া ভোটারের কথা বলেছিলাম। এবারের নির্বাচনে চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় গতবছরের চেয়ে ভোটার কমেছে ৬৩২ জন। অর্থাৎ আমরা যে দাবিটি করে আসছিলাম, সেটিই প্রমাণিত হয়েছে।’
এবারের নির্বাচনে ফোরামের দলনেতা রাইজিং ফ্যাশনস’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু। এর আগে তিনি বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি ও পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া, তিনি পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বিটিএমএ ও বিকেএমইএ’র। আর সম্মিলিত পরিষদে এবার নেতৃত্ব দিচ্ছেন চৈতি গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম। তিনি ২০১২-১৩ সালে বিজিএমইএর পরিচালক ছিলেন। তাছাড়া, বাংলাদেশ বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ’র পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আবুল কালাম বর্তমানে সম্মিলিত পরিষদের সাধারণ সম্পাদকও।
এদিকে আওয়ামী সরকারের আমলে সর্বশেষ নির্বাচনটি বিজিএমইএ’র নিজস্ব ভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দ্বিতীয় কোনো ভেন্যুতে নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানিয়ে আসছিল নির্বাচন কেন্দ্রিক একটি জোট। তবে নিজস্ব ভবন বাদ দিয়ে ভাড়া ভেন্যুতে নির্বাচন আয়োজনে বিজিএমইএ’র অর্থের অপচয় হচ্ছে বলে অপর একটি জোটের পক্ষ থেকে এখন অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
জানা গেছে, নিরাপত্তার কারণে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম রেডিসন ব্লু কিছু শর্ত আরোপ করেছে। তবে নির্বাচন বোর্ড সেখানেই নির্বাচন করতে অনড়। মে’র শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। দেশি-বিদেশি ক্রিকেটাররা চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু হোটেলে অবস্থান করতে পারেন। সে কারণেই নিরাপত্তার প্রশ্নটি এসেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্মিলিত পরিষদের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজস্ব ভবন থাকতে ভাড়া ভেন্যুতে নির্বাচন আয়োজন করে বিজিএমইএ’র অর্থের অপচয় করা হচ্ছে। ফোরামের এক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতবছর বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে যে নির্বাচন হয়েছে, তেমন কোনো বাজে দৃষ্টান্ত আর দেখতে চাই না। তাই নিরপেক্ষ ভেন্যুতে নির্বাচন আয়োজনের দাবি করেছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ নির্বাচন পরিচালনা বোর্ডের সচিব মাহমুদুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম রেডিসন ব্লু আমাদের কিছু শর্ত দিয়েছে। সম্ভবত ক্রিকেট টিম এই হোটেলে অবস্থান করবে। নিরাপত্তাজনিত কিছু বিষয়ে শর্ত দিয়েছে। ঢাকাতেও রেডিসন ব্লু হোটেলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, চট্টগ্রামেও তাই হবে। আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই নির্বাচন আয়োজন করব।’ নিজস্ব ভবন রেখে হোটেলে নির্বাচন কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে হয়তো বিজিএমইএ’র নেতাদের কোনো পর্যবেক্ষণ ছিল। নিজস্ব ভবনে করলে হয়তো কিছু সমস্যা রয়েছে। সেজন্যই নিরপেক্ষ ভেন্যু নির্ধারণ করা হয়েছে।’
জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র প্রশাসক আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দুই পক্ষের বা প্যানেলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের ভেন্যু ঠিক করেছি। বিজিএমইএ’র নিজস্ব ভবন না হয়ে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। রাজধানীতে যদি ঢাকা রেডিসনে নির্বাচন হতে পারে, তবে চট্টগ্রামে কেন চট্টগ্রাম রেডিসনে হতে পারবে না? এসব ভেন্যুতে নির্বাচন করার খরচ হয়তো কিছুটা বাড়বে। সেটি ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা বেশি হতে পারে। কিন্তু নির্বাচন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করার ব্যাপারে টাকার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পোশাক মালিকরা দেশে-বিদেশে নানা ভ্যানুতে নানা আয়োজনে অংশ নেয়। চট্টগ্রাম রেডিসন কেন নিরাপত্তার ইস্যু তুলেছে সেটি বোধগম্য নয়। চট্টগ্রামের অংশের নির্বাচন চট্টগ্রাম রেডিসনেই হবে।’
প্রসঙ্গত, বিজিএমইএতে নির্বাচন কেন্দ্রিক দুটি প্যানেল- ‘ফোরাম’ ও ‘সম্মিলিত পরিষদ’। এই দুই প্যানেল থেকেই নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়ে থাকে। গত বছরের মার্চে বিজিএমইএ’র পরিচালনা পর্ষদের (২০২৪-২৬) নির্বাচনে সব ক’টি পদে জয় লাভ করে সম্মিলিত পরিষদ। এই প্যানেলের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিহা ডিজাইন (বিডি) লিমিটেডের চেয়ারম্যান এস এম মান্নান কচি। আর ফোরামের নেতৃত্বে ছিলেন বিজিএমইএ’র সাবেক সহ-সভাপতি ও সুরমা গার্মেন্টসের সত্ত্বাধিকারী ফয়সাল সামাদ।
ওই নির্বাচনের শুরু থেকেই ভোটার তালিকা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন ফোরামের সাবেক প্যানেল লিডার ফয়সাল। তিনি ৪০০ ভোটার নিয়ে লিখিত আপত্তি জানান। ফোরামের পক্ষ থেকে তখন জানানো হয়েছিল, মৃত ব্যক্তিও ভোটার তালিকায় রয়ে গেছে। তবে বিভিন্ন জায়াগায় ফোরাম আপত্তি জানিয়ে আসলেও তখন তা আমলে নেওয়া হয়নি। কিন্তু এবার নির্বাচন বোর্ড গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই ৬৯০ জন ভুয়া ভোটারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যদিও চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় এই সংখ্যা কিছুটা কমেছে।’
উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন এস এম মান্নান কচি। পরে সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। তবে, ওই বোর্ড নিয়েও আপত্তি ওঠে। প্রশ্নবিদ্ধ ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বোর্ড নিয়ে আপত্তি জানায় সংগঠনের একটি অংশ। পুরো কমিটির পদত্যাগ চেয়েছিল সর্বশেষ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সবকটি পদে হেরে যাওয়া প্যানেল ‘ফোরাম’। কারচুপির মাধ্যমে ওই নির্বাচন হয়েছিল বলে অভিযোগ ফোরামের। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার পরে সংগঠনটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। প্রশাসকের অধীনে এখন নির্বাচনের মাধ্যমে সংগঠনটিতে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হতে যাচ্ছে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম