Thursday 24 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জাভেদ ওভারসীসের ‘মানবপাচার’
‘মরুভূমিতে ৩ দিন ধরে না খেয়ে আছি, দেশে ফেরত নিয়ে যান’

উজ্জল জিসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১১:২৫ | আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:০৩

ছবি কোলাজ: সারাবংলা

ঢাকা: ‘মরুভূমিতে তিন দিন ধরে না খেয়ে আছি, আমার আর চাকরির দরকার নাই। আমি আর সৌদি আরবে থাকতে চাই না। আমাকে দেশে ফেরত নিয়ে যান। আর সহ্য করতে পারছি না। গত পাঁচ মাস ধরে আকামা নাই, কাজ নাই। বেতন চাইলেই মারধর করে।’— এভাবেই কেঁদে কেঁদে বলছিলেন সৌদি আরবে অবস্থানরত স্বপন মৃধা নামের এক ব্যক্তি। তার বাড়ি বাংলাদেশের নোয়াখালী।

সারাবাংলা ডটনেটের কাছে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় স্বহা জানান, রাজধানীর বনানীর জাভেদ ওভারসীসের মাধ্যমে তিনি সৌদি আরবে গেছেন। যাওয়ার পর থেকেই তাকে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে বন্দি রাখা হয়। তাকে কোন কাজ দেওয়া হয়নি। কাজ চাইলেই মারধর করা হয়। তার মতো আরও শতাধিক ব্যক্তির অবস্থা একইরকম। যাওয়ার আগে বলা হয়েছিল, সৌদি আরবে গিয়ে আকামা দেওয়া হবে। কিন্তু পাঁচ মাস পার হলেও আসল আকামা দেওয়া হয়নি। একটি আকামা দেওয়া হয়েছে তবে সেটি ইনভেলিড দেখায়। এরপর বেতন চাইলে তারা মারধর করে।

বিজ্ঞাপন

স্বপন মৃধা বলেন, ‘জাভেদ ওভারসীসের পক্ষে হাসান নামে এক লোক সৌদি আরবে থাকেন। তিনি আকামাগুলো ম্যানেজ করে থাকেন। হাসান হুমকি দিয়ে বলেন, বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোকে মেরে লাশ দেশে পাঠায় দিবো। তাদের মারধরে নওগাঁর একজন লোক মারাও গেছেন। তার লাশ দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মারধরের ভয়ে অন্তত ৫০-৬০ জন লোক ওই আস্তানা থেকে পালিয়ে যায়। এখন আমরা এক মরুভূমিতে আছি। রোজার মাসে রিয়াদ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে আল কাসিম এলাকায় লেবারি কাজ করার জন্য পাঠায়। সেখানে খেজুর ওঠানো-নামানোর কাজ করি। এর পর সেখান কাজ ছিল না। তখন আবার আমরা ফিরে আসি। এর পর শুরু হয় আমাদের ওপর নির্যাতন।’

বিজ্ঞাপন

দেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন স্বপন মৃধা। ছবি: সারাবংলা

তিনি বলেন, ‘এখন জিজিয়ান প্রদেশের এক মরুভূমিতে আটকে আছি। একজন ইয়েমেনের লোক আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু তিনি খাবার দিচ্ছেন না। বেশিরভাগ সময় না খেয়েই থাকতে হচ্ছে। ঢাকা থেকে হানিফ নামে একজন (যিনি জাভেদ ওভারসীসে দিয়েছেন) টাকা পাঠান, সেই টাকা আরেকজন কোনোরকমে পৌঁছায় দেন। তাই দিয়ে বেঁচে আছি। তবে দিন আর চলছে না। আমাকে দেশে ফেরত নিয়ে যাক। আর আমার টাকা পয়সা সব দিয়ে দিবে। না হলে আমি সবার নামে মামলা করব। জাভেদ ওভারসীস মানবপাচার করে। তারা এক খান থেকে আরেকখানে বিক্রি করে দেয়। তারা কাজ করায় নিয়ে টাকা পয়সা কিছুই দেয় না।’

স্বপনের মতো মুন্সীগঞ্জের তন্ময় নামে এক যুবক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘জাভেদ ওভারসীসের মাধ্যমে সৌদি আরবে এসেছি প্রায় দুই বছর হলো। এখনো কোনো আকামা দেওয়া হয়নি। আমি অবৈধ হিসেবে সৌদি আরবে আছি। বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে। ধার দেনা করে চার লাখ টাকা দিয়ে সৌদিতে আসছি। এভাবে আর দিন চলছে না। পালিয়ে থেকে কাজ করতে হয়। যেকোনো সময় পুলিশ ধরে নিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিতে পারে।’

সেলিম নামে পাবনার এক তরুণ ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘জাভেদ ওভারসীসের মাধ্যমে সৌদি আরবে আসছি। কোনো আকামা দেয়নি। সাত মাস হলো অবৈধভাবে আছি। পুলিশ ধরলে দেশে পাঠিয়ে দেবে। আমি দেনা করে টাকা দিয়ে সৌদি আরবে আসছি। বাড়ি গেলে ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। অথচ রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল অথবা কফি শপে কাজ দেওয়ার কথা ছিল। দুই বছর পর ছুটি হবে। এছাড়া, আকামা হবে। তবে কিছুই হয়নি। এখন আমি অবৈধভাবে আছি এবং একটি গ্যারেজে গাড়ি ধোয়ার কাজ করছি।’

রাকিব নামে মুন্সীগঞ্জের আরেক যুবক বলেন, ‘এক বছর দুই মাস হলো জাভেদ ওভারসীসের মাধ্যমে সৌদি আরবে আসছি। একটি কফি শপে কাজ পেলেও অবৈধভাবে আছি। কোন আকামা দেওয়া হয়নি। এভাবে আর অবৈধভাবে থাকতে চাই না।

স্বপন মৃধা, সেলিম, তন্ময় ও রাকিবের মতো আরও অনেকে সৌদি আরবের মরুভূমিতে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দুই তিন দিন তারা না খেয়ে থাকেন। নেই থাকার জায়গা ও খাওয়ার ব্যবস্থা। চাকরি তো নেই। আকামা ছাড়া সবসময় পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। পুলিশের ধরপাকড় চলছে। যেকোনো সময় তারাও ধরা পড়তে পারেন। কিন্তু জাভেদ ওভারসীসের লোকজনকে এতকিছু বলার পরও কোনো লাভ হচ্ছে না। তাদের আরও উল্টো হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি হত্যার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।

ছবিতে সৌদি আরবে অবস্থানরত সেলিম রাকিব ও তন্ময়।

এ সব বিষয়ে জানতে রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত রুপসা টাওয়ারের লিফটের তৃতীয় তলায় জাভেদ ওভারসীসের অফিসে উপস্থিত হয় সারাবাংলার টিম। ২০ এপ্রিল, ওইদিন অফিসে আরও অন্তত ২০০ জনকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, ভালো বেতন হবে কফি শপে। প্রথমে সাংবাদিক আসছে জানার পর অফিসের লোকজন কৌশলে বের হয়ে চলে যান। এরপর দীর্ঘক্ষণ পর ম্যানেজার ইউসুফ আলী আসেন। তিনি বলেন, ‘যারা সৌদি আরবে গেছেন তারা সবাই ভালো আছেন।’ এর পর ভিডিও বার্তা দেখালে এবং সরাসরি কথা বললে ম্যানেজার তখন বলেন, ‘দুয়েকজন আছে তাদের আকামা নেই। আমরা ব্যবস্থা করে দেব।’

মারধর করা, আকামা না দেওয়া, চাকরির ব্যবস্থা না করা, খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা না করা ইত্যাদি নানান অভিযোগ রয়েছে জাভেদ ওভারসীসের বিরুদ্ধে। তবে তাদের অভিযোগগুলো স্বীকার করে তা সমাধানের কথা জানান ম্যানেজার ইউসুফ।

যার মাধ্যমে ১২১ জন লোক জাভেদ ওভারসীস পেয়েছিলেন তার নাম হানিফ মন্ডল। বাড়ি বরগুনা জেলায়। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি বিটুবি সিস্টেমে কাজ করি। জাভেদ ওভারসীসে এখন পর্যন্ত ১২১ জন দিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ২৫ জন লোক আকামা পেয়েছেন এবং মোটামুটি ভালো আছেন। বাকিরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। নওগাঁর আফাজুল ইসলাম মল্লিক নামে একজন মারধরের পর মারা গেছেন। চার লাখ টাকা খরচ করে মরদেহ দেশে এনেছি। এছাড়া, ক্ষতিপূরণ দিয়েছি দুই লাখ টাকা। এদিকে আরও পাঁচজন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে দেশে চলে এসেছেন। তাদেরও অন্তত ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছি। জাভেদ ওভারসীসকে বলার পর তারা কোনো পাত্তাই দেয়নি। তারা লোক পাঠানোর পর আর কোনো খবর রাখে না। তাই এখন আর সেখানে লোক দিই না।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনেক লোকের আকামা হয়নি। তারা অবৈধ হিসেবে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। না খেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। অনেকেই দেশে ফিরে আসতে চাচ্ছেন। তারা এলে এত মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সেই ক্ষতিপুরণের টাকা আমি কোথায় পাব। জাভেদ ওভারসীস গায়ে লাগাচ্ছে না। এরকম কথা শুনতেই চাচ্ছে না। যাদের সৌদি আরব পাঠানো হয়েছে, তাদের ক্ষতিপুরণ দিতে না পারলে আমাকেসহ জাভেদ ওভারসীসের সকলের নামে মামলা করবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।’

এ বিষয়ে জানতে জাভেদ ওভারসীসের মালিক জাভেদ হাওলাদারকে কল করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

আকামা জাভেদ ওভারসীস মরুভূমি মানবপাচার রুপসা টাওয়ার সৌদি আরব

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর