ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা ও বাস্তবতা
৫ মে ২০২৫ ১৪:৩৯ | আপডেট: ৫ মে ২০২৫ ১৪:৪০
কাশ্মীর উপত্যকার বৈসরান অঞ্চলে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ফের উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। নিহতদের অধিকাংশই ভারতীয় পর্যটক হওয়ায় নয়াদিল্লি সরাসরি ইসলামাবাদকে দায়ী করেছে। পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ, সীমান্তে গোলাগুলি এবং নেতাদের বাগযুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এই পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন। তবে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিচার করলে এই মুহূর্তে যুদ্ধ কোনো পক্ষের জন্যই সুফল বয়ে আনবে না বলেই মনে হয়।
ঘটনার সূত্রপাত গত ২২ এপ্রিল। পেহেলগামের মতো জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে বন্দুকধারীদের হামলায় ১৬ জন নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তান মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের দায়ী করেছে। যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। এই হামলার জের ধরে ভারত ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের নাগরিকদের ভিসা বাতিল এবং সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। পাকিস্তানও এর প্রতিক্রিয়ায় একই ধরনের পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। এমনকি নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বরাবর উভয় দেশের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ স্পষ্ট ভাষায় দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করে পরিস্থিতিকে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ পর্যন্ত গড়াতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস উভয় পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘটনাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে দুই দেশকেই নিজেদের সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন।
ভারতের সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত হয়েছে। ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি স্থগিত করার আগে ভারতকে বিশ্বব্যাংককে কিছু না জানানোর বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি আন্তর্জাতিক মহল। কারণ এই চুক্তি সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো। চুক্তি অনুযায়ী চেনাব, ঝিলম ও মূল সিন্ধুর পানির সিংহভাগ পায় পাকিস্তান। এই চুক্তি স্থগিত হলে পাকিস্তানের কৃষি ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। যদিও ভারতীয় পানি বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বর্তমান চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সিন্ধুর পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা কঠিন।
অন্যদিকে পাকিস্তানের আকাশসীমায় ভারতীয় বিমানের চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছে ভারত। প্রতিদিন শত শত ভারতীয় ফ্লাইট পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করে। বিকল্প পথে চলায় তাদের পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতার দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রচলিত যুদ্ধে উভয়েরই বিশাল জনবল ও স্থলবাহিনী রয়েছে। ভারতের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৬৬ কোটি ২০ লাখ কর্মক্ষম এবং ১৪ লাখ ৬০ হাজার সক্রিয় সেনা রয়েছে। এছাড়াও তাদের ১১ লাখ ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনা ও ২৫ লাখ ৩০ হাজার আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য রয়েছে। বিপরীতে পাকিস্তানের ১৫ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১০ কোটি ৮০ লাখ কর্মক্ষম এবং ৬ লাখ ৫৪ হাজার সক্রিয় সেনা রয়েছে। তাদের রিজার্ভ সেনাও প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার। যদিও তাদের আধা সামরিক বাহিনীর সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি, তবে রেঞ্জার্স ও ফ্রন্টিয়ার কোরের মতো উল্লেখযোগ্য বাহিনী রয়েছে। সামরিক অস্ত্রের দিক থেকে ভারতের ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, কামান ও যুদ্ধবিমানের সংখ্যা পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। তবে কৌশলগত পরমাণু অস্ত্রের ক্ষেত্রে পাকিস্তান কিছুটা এগিয়ে থাকতে পারে। সার্বিক সক্ষমতায় ভারত এগিয়ে থাকলেও, সব সীমান্ত সুরক্ষিত রেখে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানো দেশটির জন্য কঠিন হতে পারে। কারণ ভারতের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বিদ্যমান। এছাড়াও চীন, বাংলাদেশ ও নেপালের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও খুব একটা মসৃণ নয়। এমন পরিস্থিতিতে দুই ফ্রন্টে বা একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাও এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল ও বিশ্লেষকদের মতে, পেহেলগামের হামলা রহস্যজনক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে। বিশেষ করে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর বিতর্কিত কার্যকলাপের পর মোদি সরকারের ভাবমূর্তি যখন তলানিতে, তখন এই হামলাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, মোদি সরকার জঙ্গি কার্ড খেলে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ভিন্ন দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করছেন। যদিও বড় ধরনের যুদ্ধের সম্ভাবনা কম, তবে ছোটখাটো সামরিক পদক্ষেপ বা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মাধ্যমে ফায়দা লোটার চেষ্টা তিনি করতে পারেন।
কাশ্মীর ভূ-স্বর্গ হিসেবে পরিচিত হলেও, ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই এটি বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু। হিন্দু রাজা হরি সিংয়ের স্বাধীন থাকার অথবা ভারতের সঙ্গে যোগ দেওয়ার ইচ্ছার বিপরীতে পশ্চিম জম্মু ও গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছিলেন। ফলস্বরূপ, ১৯৪৭ সালে পাক উপজাতীয়দের হামলার মুখে রাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে যোগ দেওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপিত হলে গণভোটের আহ্বান জানানো হয় এবং উভয় পক্ষকে সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়। কিন্তু পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার না করায় কাশ্মীর কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের ফলে আকসাই চীন অঞ্চলটি চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয় পাক-ভারত যুদ্ধ হয় এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের হস্তক্ষেপের পর ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) চূড়ান্ত হয়। ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধ এবং পরবর্তীতেও বিভিন্ন সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণ ভারতের শাসন মেনে নিতে চায় না, এটাই বিরোধের মূল কারণ। তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি উপেক্ষা করার কারণেই বছরের পর বছর ধরে কাশ্মীর অবরুদ্ধ রয়েছে।
পর্যটনকেন্দ্রে হামলার পর ভারত যেভাবে আগ্রাসী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা আরও হুমকির মুখে পড়েছে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পর মোদি সরকার বারবার সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি করলেও, বাস্তবতা ভিন্ন। দমন-পীড়নের মাধ্যমে একটি জাতির আকাঙ্ক্ষা দমন করা যায় না, কাশ্মীর তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ভারত সবসময় কাশ্মীরের যেকোনো হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে, যদিও পাকিস্তান তা অস্বীকার করে। উভয় দেশই একে অপরের দুর্বল জায়গায় আঘাত হানার চেষ্টা করছে।
সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তকে পাকিস্তান তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসেবে দেখছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সিমলা চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ, যা নিয়ন্ত্রণ রেখা না মানার একটি ইঙ্গিত হতে পারে। এছাড়াও পাকিস্তানের আকাশসীমায় ভারতীয় বিমানের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, কাশ্মীরে এ ধরনের হামলা নতুন কিছু নয়। পুলওয়ামায় ভয়াবহ হামলার পরও ভারত একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো যুদ্ধই কোনো পক্ষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনেনি। মোদি সরকারের বর্তমান প্রতিক্রিয়া যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ালেও, আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
সুতরাং, কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিকে উপেক্ষা করে ভারত রাষ্ট্রের দেওয়া সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার কারণেই সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। এমতাবস্থায় যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। বরং উভয় দেশের উচিত উত্তেজনা প্রশমন করে আলোচনার টেবিলে বসা এবং একটি দীর্ঘমেয়াদী ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি নতুন কূটনৈতিক সংলাপের সূচনা করাই এখন সময়ের দাবি।
লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এএসজি