আমরা স্বপ্ন দেখি সাধারণত দুই ভাবে। একটা স্বপ্ন দেখি ঘুমিয়ে আর দ্বিতীয়টা দেখি জেগে। ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখি তার সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা ভিন্ন। তার বৈজ্ঞানিক নানান ব্যাখ্যাও অবশ্য আছে। তবে আমার এই লেখায় মূলত কথা বলব জেগে স্বপ্ন দেখার বিষয়ে। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম আজাদের একটা বিখ্যাত কথা আছে, ‘স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে দেখো বরং স্বপ্ন সেটাই যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না।’ এখানে মূলত জেগে স্বপ্ন দেখার কথাই বলা হয়েছে। আমাদের প্রত্যেক মানুষেরই এমন কিছু না কিছু স্বপ্ন জেগে থাকে। এছাড়াও সুজি কাসিম বলেছেন, ‘স্বপ্ন ছাড়া কোনো হৃদয় হলো ডানা ছানা ছাড়া কোনো পাখির মতো।’ আমরা জানি ডানা ছাড়া কোনো পাখি উড়তে পারে না, তেমনি মানুষও স্বপ্ন ছাড়া সামনে আগাতে পারেনা। সুতরাং মানুষ যতদূর বেঁচে আছে তারা ততদূর স্বপ্ন দেখবেই। এমনকি স্বপ্নে ভাসবে, স্বপ্নে বাঁচবে। একবার স্বপ্ন ভঙ্গ হবে তো আবার দেখবে, একদিকে হয়নি তো অন্য দিকে দেখবে। স্বপ্ন দেখার কি শেষ আছে? নিশ্চয়ই উত্তর হবে ‘নেই’। যদি জীবনের অন্ত না হয়।
মাধ্যমিকে থাকা কালে একবার আমাদের এক শিক্ষক ক্লাস চলাকালিন সময়ে সবাইকে একে একে জিগ্যেস করছিলেন, ‘তোমরা বড় হয়ে কি হতে চাও?’ এটা আমাদের সমাজে ও শিক্ষা জীবনে একটা সাধারণ প্রশ্ন, যে প্রশ্নের উত্তর ছাত্র জীবনে অনেক দিতে হয়েছে। সেদিন ক্লাসে সবাই তোতাপাখির মত উত্তর দিচ্ছিল ‘ডাক্তার হতে চাই’ আর দুয়েকজন হয়ত বলেছিল ‘ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই।’ স্যার সবাইকে বাহবা দিচ্ছিলেন। কিন্তু আমি সেদিন তোতাপাখির মত পরিবার এবং সমাজের শেখানো বুলি ‘ডাক্তার হতে চাই’ না বলে নিজের মনের ইচ্ছেটাই বলেছিলাম ‘আমি ক্রিকেটার হতে চাই।’ উত্তরে ঐ শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি তাঁর (আমাদের এলাকার একজন এথলেটসের নাম বলেছিলেন) মত এলাকার স্কুল মাঠের আম্পেয়ার আর রেফারিই হতে পারবা।’ স্যার সেদিন ক্লাসে আমাকে নিয়ে আনন্দ ও তাচ্ছিল্য করছিলেন, এবং উপস্থিত সবাই স্যারের কথা শুনে আমার দেখে চেয়ে হাসছিল এবং আনন্দও পাচ্ছিল। সেদিন অবশ্য আমার মনটা খারাপ হয়েছিল। তবে ক্রিকেটে আমি আমার যথাযথ চেষ্টা করেছি। সৃষ্টিকর্তা হয়ত আমাকে সেখানে দেখতে চান নি অথবা আমার চেষ্টায় ভুল ছিল, তাই হতে পারিনি। তবে তার দায়টা সৃষ্টিকর্তার উপর ছেড়ে দিলেও ভুল হবে। সৃষ্টিকর্তার একারই কি সব দায়? তার দায় কিছুটা হলেও পরিবার, সমাজ ও তথাকথিত শিক্ষকদের উপরও পড়ে। সেদিনের ক্লাসে উপস্থিত থাকা বাকিদের কেউই আজ ডাক্তারী পড়তে যেতে পারেনি, তবে দুয়েকজন অবশ্য দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। সেদিনে তাদের ‘ডাক্তার হতে চাই’ বলায় আমি দোষের কিছু দেখছিনা বা বলছিনা। কিন্তু কথা হচ্ছে, তারা সবাই কি সত্যিই মন থেকে ডাক্তার হতে চাইত? আমার মনে হয় উত্তর হবে, না। আমাকেও আমার পরিবার শিখিয়ে দিয়েছিল ‘ডাক্তার হতে চাই’ বলতে। মাঝে মধ্যে কাউকে কাউকে বললেও মন থেকে কখনও এটা বলতাম না। কেননা ডাক্তার হওয়ার মত কোনো যোগ্যতাই আমি আমার মধ্যে উপলক্ষিত পাই নি। আমি আমার স্বপ্নকে নিজের মধ্যেই নিজের মত করে লালন করতাম। তবে আমার মত নানান কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখার পথে বাধা হয়ে দাড়াতে এরকম কিছু শিক্ষকেরাও যথেষ্ট। কারণ আমাদের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়ার একটা বিরাট অংশ জুড়ে শিক্ষকদের ভূমিকা ও অবদান অবশ্যই কাজ করে। শিক্ষকরা যেখানে বাবা-মায়ের পরে তাদের ভূমিকা পালন করেন।
আমাদের দেশে সন্তানেরা বড় হয়ে কি হবে, না হবে সেটা ঠিক করেন বাবা-মা ও তার পরিবার। আবার সেখানে এসে সায় দেন শিক্ষক ও সমাজ। কিন্তু যে মানুষটার জন্য তাদের পথ ঠিক করা সেই মানুষটারেই কোনো মতামত বা স্বপ্ন যেন থাকতে নেই। শিশুরা চিরাচরিত ভাবে তাদের বড়দের দেখে অনুসরণ করে। যেদিকে তার আগ্রহ থাকে সেদিকে তার অনুসরণ আরও দৃঢ় হয়, আগ্রহদীপ্ত হয়। সে তখন তার পথের ক্ষমতা বুঝতে পারে। সকলের প্রতিভা যে একই দিকে হবে তা কিন্তু কোনোভাবেই নয়। একেক জনের একেক রকম প্রতিভা, স্বপ্ন কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সেই প্রতিভার মূল্যায়ন করার কি কোনো সুযোগ আছে? সেরকম স্থান কি আমরা তৈরি করে দিতে পেরেছি? বোধহয় খুব জোর দিয়েই উত্তর আসবে ‘না’! এবং অবশেষে ‘না’ জয়যুক্ত হবে। সন্তানদের মেধা ও স্বপ্ন কোনদিকে কাজ করে সেটা খেয়াল না করেই আমাদের পরিবার সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চিরাচরিত সেই পথে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেয়। সন্তানদেরও তখন আর কিছুই করার থাকে না, পরিবারের মতামতকে সায় দিয়ে তাদের স্বপ্ন ও প্রতিভাকে সেখানেই স্লান করতে হয়।
আমার লেখালেখির ছোট্ট জীবনেও আমার পরিবার, প্রচলিত সমাজ ও তথাকথিত শিক্ষকদের কম বাধার সম্মখীন হই নি। অনেকে বলেন, ‘লেখালেখি করি কি হবে? কি পাইবা জীবনে?’ তাদের মধ্যে অনেকে আমার শিক্ষকও বটে। এই নিয়ে বরং উনারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও হাস্যরসিকতা করেন। কিন্তু লেখালেখিটা আমার কোনো স্বপ্ন নয়, একটা দায়বদ্ধতা ও মনের খোরাক ছিল বলেই বাধা এসে আঘাত করতে পারছে না। আবার আমার কিছু মহান শিক্ষকদের পেয়েছি যারা আমার এই পথকে স্বাগত জানিয়ে অনুপ্ররেণা দিয়ে যাচ্ছেন। সেসকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের জন্যেই বোধহয় আমার এই পথচলা নিরন্তর রয়েছে। আবার আমার এই লেখালেখি একটা ভালোলাগাও ভালোবাসার জায়গা। এটা কোনো লেখক হওয়ার বা লেখালেখিতে সফলতার জন্য কোনো স্বপ্ন বা লক্ষ্য নয়। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বলেন, ‘সাফল্য চাইলে সাফল্যকে লক্ষ্য বানিও না; তুমি যা করতে ভালোবাসো, সেটাই করতে থাক। সাফল্য নিজেই ধরা দেবে।’ এখানে সাফল্য বলতে আমার লেখাগুলো একদিন মানুষ ও পৃথিবীর কাজে আসুক এটা অবশ্যই চাই। তবে ভালোবাসা আছে বলেই লেখি। সাফল্য না আসলেও বোধকরি কিছু এসে যাবে না। আমি আমার দায়বদ্ধতার কাজ করে যেতে চাই। মহাত্মা আহমদ ছফা বলেন, ‘আমি সাধারন ৩টি কারণে লিখি। মানুষের কল্যাণ করার উদ্দেশ্যে যদি থাকে, তখন লিখি। যদি আর্টিস্টিক কিছু করার উদ্দেশ্যে থাকে, তখন লিখি। আর যখন কোনো কিছু প্রতিবাদ করার ইচ্ছা থাকে, তখন লিখি।’ আমার কাছে অবশ্য আর্টিস্টিক কিছুই নেই, তবে বাকী দুটি তাড়নায় অবশ্য আমিও লিখে থাকি।
আসি মূল প্রসঙ্গে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘A good student must be creativity’, যার বাংলা হচ্ছে, ‘একজন ভালো ছাত্রকে সৃজনশীল হতে হবে।’ কিন্তু আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর বাস্তব প্রেক্ষাপট হচ্ছে ভিন্ন। এখানে একটা শিক্ষার্থী যখন বিদ্যালয় গন্ডিতে পা রাখে তখনই ধীরে ধীরে তার সকল ‘creativity’ ধ্বংস করে দিয়ে এক গাদা নিয়মকানুন জোরে দেওয়া হয় তার মাথায়। তারপর শুরু করো মুখস্ত বিদ্যার দৌড়াদৌড়ি ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এসবের মধ্যে কখন যে তার সুপ্ত থাকা ‘creativity’ দৌড়ে পালায় তা সে নিজেও বলতে পারে না। আর মগজের ভিতরে থাকা ‘creativity’ কেটে ফেলে দিতে উদ্যম হয়ে বসে থাকেন কতিপয় শিক্ষক মহোদয়গণ। উনারা রাবারের মত সৃজনশীলতাকে মুছে দিয়ে মগজকে দোলাই করে বসিয়ে দেন মুখস্ত বিদ্যার জাগতিক যন্ত্র-মন্ত্র!
লেখক: কলামিস্ট