Friday 13 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তাপপ্রবাহের আগুনে জনজীবন বিপর্যস্ত, কিভাবে মিলবে স্বস্তি?

অমিত বণিক
২১ মে ২০২৫ ১৫:৩৯

বাংলাদেশের ৬২টি জেলার ওপর দিয়ে বইছে প্রচন্ড তাপপ্রবাহ। তন্মধ্যে দেশের ৭টি জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গত শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকাতে এ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দিনের দীর্ঘ সময়জুড়ে মেঘমুক্ত আকাশ ও সূর্যের দীর্ঘ কিরণ, বাতাসে জলীয়বাষ্প কম থাকা, বাতাসের গতিবেগ কম থাকা, উপমহাদেশীয় উষ্ণ তাপপ্রবাহ এবং পশ্চিমা লঘুচাপের অনুপস্থিতিতে গরমের তীব্রতা বেড়েছে।

প্রবাহমান তাপপ্রবাহ স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। প্রকৃতির এমন একটানা বৈরী আচরণ অভাবনীয়। কেবল দিবাভাগে নয়, অহর্নিশি অস্বস্তিকর প্রহর কাটাচ্ছেন মানুষ। সঙ্গে প্রাণিকুলও। এমনকি গাছপালা, বৃক্ষলতা, ফল-ফসল, পরিবেশ-প্রতিবেশ সবকিছু। হাঁফিয়ে উঠেছে দেশ। প্রাণঘাতী এই অসহ্য গরমে সবাই চাতকের মতো তুমুল বৃষ্টির জন্য অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত মাঝারি, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তীব্র ও তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ গণ্য করে আবহাওয়া অধিদফতর। পরিসংখ্যান অনুসারে এটি চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।

বিজ্ঞাপন

আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আরও প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে দিন ও রাতের তাপমাত্রা। আর্দ্রতার কারণে গরমের অনুভূতি হতে পারে আরও বেশি। তীব্র গরমে রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। তাপপ্রবাহের মাঝে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেন না কেউ। তীব্র গরমে শরীরে পানিশূন্যতার সম্ভাবনা দেখা দেয়। অনেক সময় মানুষ বিশেষ করে শিশুরা মূর্ছা যেতে পারে। গরমে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হলো হিটস্ট্রোক। শুরুতে হিটস্ট্রোকের আগে হিটক্র্যাম্প দেখা দেয়, যাতে শরীর ব্যথা করে, দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা লাগে। পরবর্তী সময়ে হিট ইগজোসশন দেখা দেয়, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, মাথাব্যথা করে এবং রোগী অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফা. ছাড়িয়ে যায়। এটিই হিটস্ট্রোক। তীব্র গরম ও আর্দ্রতা মোটামুটি সবার কাছেই অস্বস্তিকর। এ ধরনের পরিস্থিতি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রেও ক্ষতিকর হতে পারে। অত্যধিক তাপমাত্রা মন ও মেজাজকে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি এর কারণে গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও হতে পারে। প্রখর রৌদ্রে প্রয়োজন ব্যতীত চলাফেরা না করাই শ্রেয়। যদি করতেই হয় তবে সবসময় একটি ছাতা ব্যবহার করা উত্তম।

১৯৬৫ সালে ঢাকায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। মাঝখানের বছরগুলোয় এই পরিমাণ তাপমাত্রা আর ওঠেনি। ঢাকায় ১৯৬৫ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর আগে ১৯৬০ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ফলে সম্প্রতি তাপমাত্রা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তীব্র গরমে নাকাল দেশবাসী। কয়েক দিন ধরেই বয়ে চলছে এই তাপপ্রবাহ। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি হওয়ায় অনুভূত হচ্ছে আরও বেশি। ফ্যানের নিচেও মিলছে না স্বস্তি, বের হচ্ছে গরম বাতাস। আর তীব্র রোদে খেটে খাওয়া মানুষদের অবস্থা আরও নাজুক। কাঠফাটা রোদে জ্বলতে বসেছে ফসলের মাঠ। তীব্র তাপপ্রবাহে খাল, মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির। সুপেয় পানি পাচ্ছে না পশুপাখিরাও। রাজধানীসহ সারা দেশে তীব্র তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত জনজীবন। রোদের তীব্রতা এতটাই বেশি যে বাইরে কাজে বের হয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। একটু স্বস্তি পেতে অনেকে আশ্রয় নিচ্ছেন পার্কে কিংবা রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায়। সকাল থেকেই তাপমাত্রার পারদ উঠতে শুরু করে। তীব্র গরম উপেক্ষা করে কাজ করছেন শ্রমজীবী মানুষ। রোদের তাপে গলছে সড়কের পিচ। দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির জন্য ফরিয়াদ করছেন মানুষ। দুঃসহ গরমে মানুষের পাশাপাশি প্রাণিকুলও হয়ে উঠেছে ব্যাকুল। চলমান তাপপ্রবাহে বেশি কষ্টে আছেন খেটেখাওয়া দিনমজুর, রিকশা-ভ্যানচালক ও কৃষকরা। ফেটে চৌচির ফসলি ক্ষেত। ঝরে পড়ছে আম-লিচু। মাথা ওলটপালট হয়ে যায়। তারপর আবার যদি জ্যামে বসে থাকা লাগে তা হলে তো কথাই নেই। তীব্র এই গরম থেকে বাঁচতে অনেকেই পান করছেন বরফ মিশ্রিত আখের রস, লেবুর শরবত ইত্যাদি। দিনে তীব্র গরমের পর রাতেও নেই স্বস্তি। রাতেও প্রচণ্ড গরম অনুভূত হচ্ছে। দেশজুড়ে তীব্র তাপপ্রবাহ কোনোভাবেই কমছে না। গরমে দীর্ঘ সময় রোদে থাকলে হিটস্ট্রোক হয়ে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে লোকজন। শিশু ও বয়স্কদের জন্য এই ঝুঁকি আরও বেশি। গরম থেকে রক্ষা পেতে পাতলা ও হালকা রঙের পোশাক পরা উচিত। বাড়ির বাইরে থাকার সময় সরাসরি রোদ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা। শরীরে পানিশূন্যতা এড়াতে অতিরিক্ত পানি ও শরবত পান করা। স্যালাইন পানিতে থাকা সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও চিনি শরীর সজীব রাখতে বিশেষভাবে কার্যকর। দীর্ঘ সময় গরমে থাকলে স্যালাইন পান করা উত্তম। গ্রীষ্মকালীন ফল দিয়ে তৈরি তাজা জুস পান করা। মাংস এড়িয়ে বেশি করে ফল ও সবজি খাওয়া। সবসময় ছাতা বা টুপি সঙ্গে রাখা। ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করতে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা। চেষ্টা করা যেন দিনে কম বাইরে যেতে হয়। বাইরে তাপমাত্রা যাই হোক না কেন আমাদের শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রা প্রায় স্থির রাখতে সক্ষম। কিন্তু অতিরিক্ত গরমে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজ করা বন্ধ করে দিলে তখন তাকে হিটস্ট্রোক বলা হয়। এর ফলে ঘাম বন্ধ হয়ে গিয়ে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। হিটস্ট্রোকের লক্ষণ শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যাওয়া। গরমে অচেতন হয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরা, তীব্র মাথাব্যথা, ঘাম কমে যাওয়া, ত্বক গরম ও শুষ্ক হয়ে যাওয়া, শারীরিক দুর্বলতা ও পেশিতে টান অনুভব করা, বমি হওয়া। বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে জলীয়বাষ্পে পরিপূর্ণ। মৌসুমি অক্ষ বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণে ভারতীয় উপকূলে অবস্থান করছে। তাই আকাশে মেঘ জমছে না। আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী। সারা পৃথিবীকেই এর ফল ভোগ করতে হবে। ভয়াবহ গরমের অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এ ছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবেই আবহাওয়া দ্রুত এমন দুর্যোগপূর্ণ হচ্ছে। ওলটপালট দেশের ঋতুকাল। আষাঢ়ের মেঘের দেখা নেই আকাশে। ভরা বর্ষায় চলে খরা। বৃষ্টি খরায় বিপর্যস্ত মানুষ। সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র রোদের দেখা মেলে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদ যেন আগুনের ফুলকি হয়ে ঝরছে। বিশেষ করে দুপুরের পর আগুন ঝরা রোদের তেজে ঘর থেকে বাইরে বের হওয়া মুশকিল। অফিস-আদালত এবং হাটবাজারে গরমের কারণে জনচলাচল কমে গেছে। রিকশাওয়ালারাও যাত্রী পাচ্ছেন না। অনেককেই দেখা যাচ্ছে দিনের পরিবর্তে বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রিকশা ও অটোরিকশা চালাচ্ছেন আয় রোজগারের আশায়। আবার দিনমজুররা এত গরমে কাজে যেতে না পেরে উপার্জন করতে পারছেন না। টানা মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। প্রচণ্ড গরমে কিছু ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মামস, জলবসন্ত, ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার বেড়ে যায়। বয়স্ক, শিশু এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম যেমন- গর্ভবতীদের মধ্যে এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সারা দিন কড়া রোদের সঙ্গে প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমে সর্দি, কাশি, জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণের জন্য মনুষ্যসৃষ্ট অনেক কারণকেই দায়ী করা হচ্ছে। মানুষ প্রকৃতির ওপর নানাভাবে খবরদারি করছে। খাল-বিল, নদী-নালা দখল করা হচ্ছে। পাহাড় কাটা চলছে নির্বিচারে।

কৃষিজমির ওপর নির্মিত হচ্ছে ঘরবাড়ি। নানাভাবেই চলছে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার। যে কারণে প্রকৃতি বৈরী হয়ে উঠছে। আমরা নিজেরাই নষ্ট করছি নিজেদের সব অর্জনকে। ফলে দেখা দিয়েছে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ। প্রকৃতিতে কেন এত তাপপ্রবাহ। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পুরো পৃথিবীর প্রাকৃতিক চরিত্রেও পরিবর্তন এসেছে। তাপপ্রবাহে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির, জ্বালানি ও পানি সরবরাহের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে চলমান তাপপ্রবাহ। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত অসহ্য গরম থাকে। সন্ধ্যার পর গুমোট হয়ে ওঠে পরিবেশ, রাতেও ভ্যাপসা গরম। বিশ্ব মানচিত্রে ক্ষুদ্র এক ভূখণ্ড আমাদের এই বাংলাদেশ। জলবায়ুর পরিবর্তন ও এর প্রকৃত বা সম্ভাব্য প্রভাবের সঙ্গে প্রাকৃতিক বা মানুষের জীবনাচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া যাতে ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায় বা সম্ভাবনার যথার্থ ব্যবহার করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে পৃথিবীর অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে এবং প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ ও পরিবেশ দূষণের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

সারাবাংলা/এএসজি

অমিত বণিক তাপপ্রবাহ মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর