কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। ১৮৯৯ সালের ২৫ মে, বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। এজন্য তার ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। কবির পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। এবছর কবির ১২৬তম জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। জন্মদিনে কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
প্রেম, দ্রোহ, সাম্য ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ। তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় তার লেখনী গোটা ভারতবর্ষের মানুষকে প্রেরণা জুগিয়েছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতে তার বিদ্রোহী চেতনা ফুটে ওঠে, তিনি পরিণত হন বিদ্রোহী কবিতে। সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, অত্যাচার, নিপীড়ন, অনাচার, বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে আপসহীন সাহসী কন্ঠে সোচ্চার হয়ে কবি লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, সংগীত, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও অন্যান্য লেখনী। আর সে কারণে ইংরেজ সরকার তার গ্রন্থ ও রচনা বাজেয়াপ্ত করেছে এবং তাকে কারাদণ্ডও দিয়েছে। কারাগারেও বিদ্রোহী নজরুল বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। টানা ৪০ দিন অনশন করে ব্রিটিশ সরকারের অন্যায়-অত্যাচার জেলজুলুমের প্রতিবাদ করেছিলেন। কবি নজরুল একটি শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিকসমাজ গড়ার জন্য লড়াই করে গেছেন জীবনভর। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি যিনি পূর্ণাঙ্গভাবে ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন।
তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের শোষণ, নির্যাতন, অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাত্র ২০ বছর বয়সী এক তরুণের হৃদয়ে যে বিদ্রোহ, শোষণ, বঞ্চনা, পরাধীনতা, গ্লানি, ক্ষোভ, দ্রোহ জেগে ওঠেছিল তারই বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়, যা তখনকার ক্ষুব্ধ প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে প্রজ্বলিত মশাল হিসেবে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠেছিল। তিনি প্রতিবাদীকন্ঠ নিয়ে আবির্ভূত হয়ে বলেছিলেন- ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ অথবা মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না /অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না’। যা পরবর্তীকালে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অন্যতম প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়।
নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করে দেখা যায়, নজরুল ছিলেন একজন ইতিহাস ও সময়সচেতন লেখক। যার স্পষ্ট প্রভাব তার লেখনিতে পাওয়া যায়। তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের চিত্রকে নজরুল তার সাহিত্যে মহাসমারোহে ধারণ করেছেন।
রবীন্দ্রসৃষ্ট বিশাল সৃষ্টিজগতের পাশে কবি নজরুল গড়ে তোলেন নিজস্ব এক সৃষ্টির জগত, ফুটিয়ে তোলেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নজরুলের অনন্য এই অভ্যুদয়কে এই বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন, ‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু, আঁধারে বাধ অগ্নিসেতু’। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগত এবং সাংস্কৃতিক জাগরণের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
কবি নজরুলের কবিতা “চল্ চল্ চল্“ বাংলাদেশের রণসংগীত। প্রেম, দ্রোহ, মানবতা কবির রচনাকে করেছে চিরঞ্জীব, নিয়ে গেছে গণমানুষের দ্বারে দ্বারে। কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান…’। কবির এমন অজস্র রচনা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালিদের দিয়েছে শক্তি, জুগিয়েছে প্রেরণা। এখনও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে তার রচনা আমাদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে, আলোড়িত করে।
শত প্রতিবন্ধকতা, শত প্রতিকূলতা, শত বিরোধিতা, শত সমালোচনা, নিরুৎসাহ, তিরষ্কার কোনো কিছুতেই নজরুলের প্রতিভাকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে হিন্দু কুলীন ঘরের কন্যা প্রমীলা দেবীকে বিয়ের পর তৎকালীন মোড়ল-কবি-সাহিত্যিকরা নজরুলকে সমাজচ্যুত করা থেকে শুরু করে তার দারিদ্র্য, শিক্ষা, পরিবার, ভাষাজ্ঞান, বিশ্বাস, চর্চা এবং কাব্যে তার বিষয় নির্বাচনসহ এমন কিছু ছিল না, যার কঠোর ভাষায় নিন্দা করে তাকে টেনে নামানোর চেষ্টা করা হয়নি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়ে যায়নি, তাকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় নজরুলের বিস্ময়কর প্রতিভার টের পেয়েছিলেন ওই সময় প্রথম বাঙালি নোবেলবিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাইতো আশীর্বাণী দিয়ে কবিকে বলেছিলেন, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু… আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু’।
কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক জানলেও তিনি ছিলেন চির প্রেমের কবি, ছিলেন যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বিদ্রোহী, কিন্তু তার প্রেমিক রুপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন- ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ পৃথিবীতে এমন খুব কম মানুষই আছেন যিনি প্রেমের টানে রক্তের সম্পর্ককে তুচ্ছ করে, অস্বীকার করে পথে বেরিয়ে পড়তে পারেন।
কবি নজরুল তার ৭৭ বছরের সংগ্রামী জীবনের ৩৪ বছরই ছিলেন নির্বাক (১৯৪২-১৯৭৬)। জন্মের পর থেকে মাত্র ৪৩ বছর কবি স্বাভাবিকজীবন কাটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বেঁচে থাকার জীবনসংগ্রাম, অভাব-অনটন, নানা প্রতিকূলতা, জেলজুলুম ও হুলিয়ার মধ্যেই তার সাহিত্যচর্চার সময় ছিল মাত্র ২৪ বছর (১৯১৯-১৯৪২)। কিন্তু মাত্র ২৪ বছরের সৃষ্টিশীল জীবনেও তার গগণবিদারী দিগ্বিজয়ী প্রভাব। এই ২৪ বছরে নজরুল সৃষ্টি করে গেছেন ২২টি কাব্যগ্রন্থ, সাড়ে ৩ হাজার, মতান্তরে ৭ হাজার গানসহ ১৪টি সংগীত গ্রন্থ, ৩টি কাব্যানুবাদ ও ৩টি উপন্যাস গ্রন্থ, ৩টি নাটক, ৩টি গল্পগ্রন্থ, ৫টি প্রবন্ধ, ২টি কিশোর নাটিকা, ২টি কিশোর কাব্য, ৭টি চলচ্চিত্র কাহিনিসহ অসংখ্য কালজয়ী রচনা। তাইতো একাধারে তিনি কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিশু সাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, গীতিকার, সুরকার, স্বরলিপিকার, গীতিনাট্যকার, গীতালেখ্য রচয়িতা, চলচ্চিত্র কাহিনীকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক, বাদক, সঙ্গীতজ্ঞ ও অভিনেতা।
১৯৪১ সালের শেষের দিকে কবি যখন ‘নন্দিনী’ চলচ্চিত্রের সংগীত রচনা ও সুরারোপ নিয়ে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। লুম্বিনী পার্ক ও রাচি মেন্টাল হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলে এক বছরেরও বেশি সময়। ১৯৫৩ সালে কবিকে পাঠানো হয় ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে। কিন্তু ততদিনে সবই শেষ। বাকশক্তি একেবারেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। সেই ১৯৫৩ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত নির্বাক ও অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় অনেকটা অবহেলা-অনাদরে নীরবে-নিভৃতেই কাটে কবি নজরুলের জীবন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবির জন্মদিনে তাকে সপরিবারে ঢাকায় নিয়ে এসে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তার কবিতা ‘চল্ চল্ চল্- ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’কে তিনি সামরিক সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করে কবিকে সম্মানিত করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি (বর্তমানে বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িকচেতনার অনন্য বাতিঘর। এজন্য তিনি ভিন্নধর্মী একজনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ছিলেন। ভিন্ন ধর্মের অনেক সংগীত তার লেখা, যা অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে নজরুল সবসময়ই সোচ্চার ছিলেন। সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানুষ পরিচয়ই সবচেয়ে বড় পরিচয়। মানবতাবাদী কবি এজন্যই তিনি তার কবিতায় বলছিলেন-
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
বর্তমান সময়ে দেশে দেশে যখন সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ও ধর্মীয় কুসংস্কার বাড়ছে, তার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও মানবতার কবি নজরুল চর্চার বিকল্প নেই।
লেখক: কলামিস্ট